6 C
Toronto
শনিবার, মার্চ ১৫, ২০২৫

চার রাউন্ড গুলির পর হ্যান্ডকাপ পরানো হয় সিনহাকে

চার রাউন্ড গুলির পর হ্যান্ডকাপ পরানো হয় সিনহাকে - the Bengali Times
ঘটনার প্রায় ১৮ মাস পর রায়ের দিন ধার্য করেন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাঈল

বহুল আলোচিত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হবে সোমবার (৩১ জানুয়ারি)। ঘটনার প্রায় ১৮ মাস পর রায়ের দিন ধার্য করেন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাঈল। গত বছর ২৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে মামলাটির বিচারকাজ শুরু হয়। চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি সর্বশেষ দুই আসামির পক্ষে তাদের আইনজীবীদের যুক্তি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আগামী ৩১ জানুয়ারি রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করেন এই বিচারক।

এদিকে র‌্যাবের তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী জানা গেছে, সেদিন- পুলিশের সোর্স নুরুল আমিনের কল পেয়ে ইন্সপেক্টর মো. লিয়াকত আলী টেকনাফের শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে ছুটে আসেন। তড়িঘড়ি করে সঙ্গে কোন ফোর্স না নিয়ে এসআই দুলালসহ মোটরসাইকেলে সেখানে পৌঁছে অস্ত্রসহ অবস্থান নেন লিয়াকত। অপেক্ষা করতে থাকেন সিনহার গাড়ির আগমনের।

- Advertisement -

সেদিন রাত ৯টা ২০ মিনিটে বিজিবি চেকপোস্ট অতিক্রম করে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার গাড়ি। এরপর ৫ মিনিট পরেই গাড়িটি পৌঁছে যায় শামলাপুর চেকপোস্টে। এপিবিএন সদস্য কনস্টেবল রাজীব গাড়িটি থামানোর সংকেত দেন। সংকেত পেয়ে থেমে যায় সিনহার গাড়ি। কনস্টেবল রাজীব পরিচয় জানতে চাইলে বাম পাশে বসা সাহেদুল ইসলাম রিফাত গাড়ির জানালা খুলে দেন। এসময় গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিজের পরিচয় দেন। কুশল বিনিময় শেষে কনস্টেবল রাজীব ও অন্য দুই এপিবিএন সদস্য এসআই শাহজাহান আলী এবং কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল-মামুন ইমন স্যালুট দিয়ে গাড়িটি চলে যাওয়ার সংকেত দেন।

সংকেত পেয়ে গাড়িটি এগোতেই মেজর সিনহা নাম শুনেই পেছন থেকে চিৎকার করে সামনে চলে আসেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত। আবার তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। পুনরায় তিনি নিজেকে মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা বলে পরিচয় দেন। নাম শুনে উত্তেজিত হয়ে লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে ব্যারিকেড টেনে রাস্তা বন্ধ করে দেন লিয়াকত। রাস্তা ব্লকে লিয়াকতকে সহায়তা করেন এসআই নন্দ দুলালও।

এরপর ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তার পিস্তল তাক করে চিৎকার করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে গাড়িতে থাকা লোকদের দুই হাত উপরে উঠিয়ে গাড়ি থেকে নামতে বলেন। ইন্সপেক্টর লিয়াকতের চিৎকারে রাস্তার দুই পাশের লোকজন এবং বাজারগামী লোকজন ঘটনাস্থলে ঘটনা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে যায়।

উল্লেখ্য যে, ঘটনাস্থলটি পুলিশের একটি গুরুত্বপূর্ণ চেকপোস্ট এবং উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন সোলার দ্বারা আলোকিত স্থান হওয়ায় উক্ত স্থানের সবকিছু আশপাশের মসজিদ, বাজার ও রাস্তায় চলাচলকারী লোকজন পরিষ্কারভাবে দেখতে পায়।

ইন্সপেক্টর লিয়াকতের নির্দেশে দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে আসেন ২য় আসনে বসা সাহেদুল ইসলাম রিফাত। পরে ড্রাইভিং সিটে বসা সিনহা গাড়ি থেকে দুই হাত উঁচু করে নেমে লিয়াকত আলীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।

ওই সময় ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী মেজর সিনহার পরিচয় নিশ্চিত জেনে, তার কোনো কথা না শুনে মেজর সিনহাকে ২ রাউন্ড গুলি করে এবং কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে আরও ২ রাউন্ড গুলি করলে তিনি রাস্তায় পড়ে যান। গুলি করার পর ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে মেজর সিনহাকে ও সিফাতকে হ্যান্ডকাপ পরানোর নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশে এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত আহত সিনহাকে হ্যান্ডকাপ পরায়। কিন্তু এসআই শাহজাহানের নিকট হ্যান্ডকাপ না থাকায় ইন্সপেক্টর লিয়াকত তাকে গালাগালি করে এবং রশি এনে বাঁধতে বলে। তখন কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন ইমন পাশের শামলাপুর বাজারের দোকান থেকে রশি নিয়ে আসলে লিয়াকত আলীর নির্দেশে এসআই শাহজাহান ও কনস্টেবল রাজিব মিলে সাহেদুল ইসলাম প্রকাশ রিফাতকে বেঁধে ফেলে।

গুলিবিদ্ধ মেজর সিনহা তখন ব্যাথায় গোঙ্গাচ্ছিলেন। এসময় তিনি কাকুতি মিনতি করতে থাকেন পানির জন্য। এটা শুনে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আরও উত্তেজিত হয়ে যান এবং বলে তোকে গুলি করেছি কি পানি খাওয়ানোর জন্য? এই কথা বলে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আহত সিনহার কাছে যায়। তারপর বুকের বামপাশে জোরে জোরে লাথি মারতে থাকেন এবং পা দিয়ে চেপে ধরেন।

এদিকে, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে ফোন করে এসআই নন্দ দুলাল শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে কিছু পুলিশ সদস্য পাঠানোর জন্য বলেন। নির্দেশ পেয়ে একটি সিএনজিতে ছুটে আসেন এসআই লিটন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, কামাল হোসেন আজাদ ও ছাফানুল করিম। তাদেরকে সিনহার গাড়ি তল্লাশির নির্দেশ দেন লিয়াকত। তল্লাশি করে, গাড়ির ভিতরের সামনের দুই সিটের মাঝখান হতে একটি পিস্তল এবং ড্যাশ বোর্ডে কিছু কাগজপত্র, ক্যামেরা, সিডিবক্স ও ভিডিও করার যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়।

এদিকে, লিয়াকত আলীর সফলতার ফোন পেয়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ একটি সাদা মাইক্রোবাসে এবং সঙ্গে একটি ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। তখন রাত ১০টা। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই ওসি প্রদীপ কুমার ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীর সঙ্গে একান্তে আড়ালে আলাপ করেন।

এরপর ওসি প্রদীপ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকা মেজর সিনহার কাছে যান। তখন ওসি প্রদীপ কুমার দম্ভোক্তি করে বলেন, ‘অনেক টার্গেট করার পর কুত্তার বাচ্চারে শেষ করতে পারছি।’ তারপর ওসি প্রদীপ সিনহাকে পা দিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখেন। তখনও তিনি জীবিত ছিলেন এবং পানি পান করতে চাচ্ছিলেন। এসময় সিনহাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে বুকের বাম দিকে জোরে লাথি মারে এবং মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তার পায়ের জুতা দিয়ে গলায় পাড়া দিয়ে ধরলে নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়।

সিনহা হত্যা মামলার চার্জশিটে ১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা হলেন- টেকনাফ মডেল থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক আইসি লিয়াকত আলী, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন আজাদ ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, কেটনাফ মডেল থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাগর দেব এবং সেসময়ে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা এসআই মো. শাহজাহান আলী, কনস্টেবল রাজীব হোসেন ও আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ইমন। এছাড়া টেকনাফ থানা পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াছ উদ্দিন।

গত ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ রোডের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা দায়ের করে। পরে ওই বছরের ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এরপর মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় র‍্যাব।

ওই বছরেরই ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র‍্যাব-১৫ কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম। এতে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে।

এরপর ২৭ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয় এবং ২৩ আগস্ট থেকে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। যা শেষ হয় গত ১ ডিসেম্বর। পরে ৬ ও ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় আসামিদের ৩৪২ ধারায় বক্তব্য গ্রহণ।

তদন্ত শেষে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫-এর তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। ঘটনার প্রায় ১৮ মাস পর রায়ের দিন ধার্য করেন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাঈল।

এদিকে, আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার দাবি জানিয়েছে সিনহার পরিবার। সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস সংবাদমাধ্যমকে মামলার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, আমার ভাইকে যারা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের সবাইকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হোক। এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ড যেন আর না ঘটে। আমার মতো আর কোনও বোনের বুক যেন খালি না হয়। অপরাধ করে কেউ যেন পার না পায়। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, এটাই রায়ে প্রমাণ হোক।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles