9.7 C
Toronto
শনিবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৫

জোড়া বোনের দুঃসহ জীবন, মাতালদের স‌ঙ্গে রাত কাটাতে পাঠাতেন মা

জোড়া বোনের দুঃসহ জীবন, মাতালদের স‌ঙ্গে রাত কাটাতে পাঠাতেন মা - the Bengali Times
ডেইজি এবং ভায়োলেট ছবি সংগৃহীত

দুই বোনের শরীর সংযুক্ত হয়ে জন্ম হওয়ার কারণে তাদের ইংল্যান্ডের শয়তান বলে ডাকা হতো। তারা এতটাই দুর্ভাগ্য-বতী ছিল যে, জন্মের পর তাদের জন্মদাত্রী মা তাদের বিক্রি করে দেয়। যে তাদের কিনে নেয় সেও এই যমজদের শান্তিতে রাখেনি।

মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকে তাদের দিয়ে টাকা উপার্জন করিয়েছেন। তারা অনেক টাকা উপার্জনও করেছেন। কিন্তু তাদের উপার্জিত টাকার এক কানাকড়িও নিজেদের কাছে রাখতে পারেনি। সেই টাকা নিয়ে গেছে তাদের দত্তক নেয়া মা। শুধুই কি তাই, তাদের জীবনসঙ্গীও তাদেরকে ছেড়ে গেছেন। এমনকি শেষ জীবনে একঘরে বন্দী অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। আজ এই হতভাগা দুই যমজ বোনের ৬০ বছরের জীবনের কষ্টের কাহিনী বলবো আপনাদের।

- Advertisement -
জোড়া বোনের দুঃসহ জীবন, মাতালদের স‌ঙ্গে রাত কাটাতে পাঠাতেন মা - the Bengali Times
ডেইজি এবং ভায়োলেট

এই কাহিনী শুরু ইংল্যান্ডে। ১৯০৮ সালে কেটস কিনার নামের একজন নারী বিয়ে না করেই গর্ভবতী হয়ে যান। তার দুটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তান জন্ম হয়। তবে তারা ছিল যমজ। এই দুই বোনের শরীরের বাকি সবকিছু আলাদা ছিল। তবে তাদের কোমর থেকে শুরু করে পেট পর্যন্ত জোড়া লাগানো ছিল। সেসময় ডাক্তাররা বলেছিলেন যদি এদের কেটে আলাদা করা হয়, তাহলে একটি শিশু বাঁচবে না। আবার এমনটাও হতে পারে যে, দুজনই মারা যাবে। ডাক্তার এটিও বলেছিলেন, এই দুই বোন এক কিংবা দুই মাসের বেশি বেঁচে থাকতে পারবে না।

এই দুই বোনের নাম ছিল ডেইজি এবং ভায়োলেট। সেসময় যে সব বাচ্চারা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিয়ে জন্মা হয়, তাদের শয়তান মানা হতো। তাদের উপর করা হতো নানা রকম অত্যাচার। তাই তাদের মা এই যমজ বোনদের ম্যারি হিল্টন নামের এক নারীর কাছে বিক্রি করে দেন। এই ভেবে যে, এই দুই সন্তান হয়তো বা তার পাপ কর্মের ফল। বিয়ে না করে মা হওয়ায় হয়তো তিনি শয়তানের জন্ম দিয়েছেন। আর এই দিকে ম্যারি এই যমজ বোনকে কিনেছিলেন তার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। তিনি আগে থেকেই এ যমজ বোনকে দিয়ে টাকা উপার্জনের পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন।

জোড়া বোনের দুঃসহ জীবন, মাতালদের স‌ঙ্গে রাত কাটাতে পাঠাতেন মা - the Bengali Times
ম্যারি এই যমজ বোনকে কিনেছিলেন তার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য

আর সেই থেকেই তাদের কষ্টের কাহিনী শুরু। সন্তানকে বিক্রি করে দেয়ার কিছুদিন পরেই তাদের মা মারা যায়। আর এদিকে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই দত্তক নেয়া মা ম্যারি এই যমজ দুই বোনকে দিয়ে ব্যবসা শুরু করে। সে তাদের বিভিন্ন বারে প্রদর্শনীর জন্য পাঠাতে থাকে। আসলে ম্যারি যমজ বোন দুটিকে তাদের মায়ের কাছ থেকে কিনে নেন তার এবং তার স্বামীর মদের দোকানের নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য। সেই বারে ডেইজি এবং ভায়োলেট নাচতো। আর সেখানে বিভিন্ন মানুষ আসতো তাদেরকে দেখার জন্য।

টাকা দিয়ে ডেইজি এবং ভায়োলেটকে দেখতে হতো। লোকজন নেশার ঘোরে হাতে মদ, সিগারেট নিয়ে তাদের কাছে যেতো। এটি দেখার জন্য তারা কীভাবে একজন আরেকজনের সঙ্গে জোড়া লেগে আছে। এমনকি লোকজন ডেইজি এবং ভায়োলেটের জামাগুলো উঠিয়ে পর্যন্ত দেখতো। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই দুটি বাচ্চাকে মদের নেশায় মগ্ন পুরুষেরা জামা উঠিয়ে দেখছে। ভাবতেও কতটা ভয়ংকর।

জোড়া বোনের দুঃসহ জীবন, মাতালদের স‌ঙ্গে রাত কাটাতে পাঠাতেন মা - the Bengali Times
লোকজন নেশার ঘোরে হাতে মদ সিগারেট নিয়ে তাদের কাছে যেতো

এদিকে তাদের দত্তক নেয়া মাও ছিলেন নিজেই দুশ্চরিত্রা। তিনি প্রতিদিন নতুন নতুন পুরুষ ঘরে নিয়ে আসতো। তাদের সঙ্গে ফুর্তি করার জন্য। আর সেসব পুরুষেরা ডেইজি এবং ভায়োলেটের উপর করতো অত্যন্ত মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন। ডেইজি এবং ভায়োলেট কিছু বলতেও পারতো না। এমনকি পালাতেও পারতো না। কেননা তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে জোড়া লাগানো। পালাবে কি করে? আর কোথায়ই বা যাবে যেখানে যাবে সেখানেই তো সবাই তাদেরকে শয়তান ভেবে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে।

তাদের ওপর যে অন্য কোনো পুরুষেরাই শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করতো, তা কিন্তু নয়। ম্যারি হিল্টনও তাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করতো। কথা না শুনলেই বেল্ট দিয়ে পিটাতো। টাকা উপার্জন করতে না পারলেই মার খেতে হতো। ম্যারি মেয়ে দুটিকে নাচের এবং মনোরঞ্জনের নানান প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় করে তোলেন। আর এ কারণেই বেশ খ্যাতি অর্জন করেন তারা। তবে তাদের কাজের মধ্যে দিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না। কেননা ম্যারি এবং তার স্বামী মেয়ে দুইটির রোজগারের সব টাকা আত্মসাৎ করতো।

জোড়া বোনের দুঃসহ জীবন, মাতালদের স‌ঙ্গে রাত কাটাতে পাঠাতেন মা - the Bengali Times
ম্যারি মেয়ে দুটিকে নাচের এবং মনোরঞ্জনের নানান প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় করে তোলেন

ডেইজি এবং ভায়োলেটের যখন তিন বছর বয়স, তখন থেকেই ম্যারি তাদের দিয়ে টাকা উপার্জন করানোর জন্য প্রথমে অস্ট্রেলিয়া, পরে জার্মানি নিয়ে যায়। এরপর আরো বেশি টাকা উপার্জনের জন্য তাদের নিয়ে যাওয়া হয় আমেরিকায়। তবে সেখানে তাদের শারীরিক সমস্যার জন্য এসব কাজ করতে মানা করা হয়েছিল। কিন্তু ম্যারি ছিল খুব চালাক। তিনি ১৯১৫ সালের মিডিয়ার সাহায্যে আমেরিকার সরকারকে ইমোশনালই ব্ল্যাক-মেইল করে। তখন আমেরিকা-বাসীর মন কেঁদে ওঠে ডেইজি এবং ভায়োলেটের জন্য। তবে আমেরিকা-বাসী তো এটা জানতো না যে তারা ম্যারির ফাঁদে পা দিয়েছে।

যতদিন পর্যন্ত ম্যারি বেঁচে ছিল ততদিন পর্যন্ত সে এই যমজ বোনদের উপর অত্যাচার করেছে। তাদের শোষণ করেছে। আর ম্যারি মারা যাওয়ার পর তার মেয়ে এডিত এবং তার স্বামী তাদের দায়িত্ব নেন। তখন তাদের জীবন আরো বেশি কষ্টকর হয়ে ওঠে। কারণ এডিত সবসময় তাদের একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখতো। এই ভেবে যে, এই যমজ বোনদের যদি কেউ অপহরণ করে নিয়ে যায়। কারণ সেসময় ডেইজি এবং ভায়োলেট অনেক টাকা উপার্জন করতো। যদিও কোনো টাকাই এই দুই বোনের ঝুলিতে আসেনি কখনো।

জোড়া বোনের দুঃসহ জীবন, মাতালদের স‌ঙ্গে রাত কাটাতে পাঠাতেন মা - the Bengali Times
ম্যারি মারা যাওয়ার পর তার মেয়ে এডিত এবং তার স্বামী তাদের দায়িত্ব নেন

শুধু কি তাই, তাদের দিয়ে জোর করে নাটক করানো হতো। এমনকি সেখানে তাদের বাজাতে হতো বাদ্যযন্ত্র। তবে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এই দুই বোনের শরীরের গঠন এমন ছিল যে, তাদের কাছে কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা মানেই স্বয়ং নরকে দাঁড়িয়ে থাকা। কিন্তু উপায় নেই। তাদের তো টাকা উপার্জন করে এডিতকে দিতে হবে। তা না হলে খেতে হবে বেদম মার।

১৯২০ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তারা এত টাকা উপার্জন করেছিল যা বলার মতো না। তারা সেসময় বব হোপ, চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গেও কাজ করেছিলেন। কখনো কখনো তো এমনটাও হতো যে তারা এক সপ্তাহে পাঁচ হাজার ডলারেরও বেশি উপার্জন করতো। তবে কখনোই তারা নিজেদের উপার্জিত এই টাকা ভোগ করতে পারেনি। তারা শুধু উপার্জন করেই গেছে।

তবে ২১ বছর বয়সে তাদের জীবনে আসে নতুন এক পর্ব। এক জাদুকরের নজর পড়ে তাদের ওপর এবং সে ডেইজি এবং ভায়োলেটকে তাদের গোলামের জীবন থেকে মুক্তি দেয়। ডেইজি এবং ভায়োলেট তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন এবং এডিতের কাছ থেকে মুক্তি পায়। ১৯৩১ সালে তারা প্রথম তাদের স্বাধীন জীবন পায়। তারা নিজেরাও জানতো না যে, তারা পুরো আমেরিকায় কতটা বিখ্যাত হয়ে গেছে। তাদের মুক্তির পর সরকার তাদের এক লাখ ডলার পুরস্কারও দেন। তখন ডেইজি এবং ভায়োলেট স্বাধীন। যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে, যা ইচ্ছে করতে পারে।

জোড়া বোনের দুঃসহ জীবন, মাতালদের স‌ঙ্গে রাত কাটাতে পাঠাতেন মা - the Bengali Times
তাদের বিয়ে হয় তবে বিয়ে মাত্র ১০ দিন স্থায়ী ছিল

তারা একজনকে বিয়েও করেছিল। কিন্তু তাদের বিবাহিত জীবন সুখী হলো না। তাদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য আমেরিকা তাদের বিয়ে বন্ধ করে দেয়। এরপর শেষমেশ নর্থ ক্যারোলিনাতে বসবাস শুরু করেন তারা। সেখানে ভায়োলেট ১৯৩৬ সালে অভিনেতা জেমস মোরকে বিয়ে করেন। যিনি ছিলেন একজন শিল্পী। তাদের বিয়ে ১০ বছর টিকে ছিল।তারপর তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। আর ডেইজি ১৯৪১ সালে এক নৃত্যশিল্পী হ্যারল্ড এস্টেপকে বিয়ে করেন। যিনি বাডি সাওয়ার হিসেবেও বেশ পরিচিত। তিনিও একজন শিল্পী ছিলেন। কিন্ত তাদের সুখ বেশিদিন টিকলো না। কেননা তাদের বিয়ে মাত্র ১০ দিন স্থায়ী ছিল।

১৯৩২ সালে আমেরিকার এক পরিচালক টড ব্রাউনিং তাদের জীবনী নিয়ে একটি মুভি বানিয়েছেন। তার নাম ছিল ‘ফ্রিক্স’। সেই মুভিটি পুরো আমেরিকায় বেশ হিট হয়েছিল। কিন্তু এত যশ আর খ্যাতির সত্ত্বেও তাদের জীবনে ছিল না কোনো শান্তি। ১৯৫১ সালে বয়স বাড়ার কারণে তারা আর এমন ধরনের কাজ করতে পারতো না। তাই টাকাও তেমন উপার্জন করতে পারতো না। সেসময় তারা রাস্তায় একটি হট-ডগের দোকান দেয়। কিন্তু তাদের শারীরিক অবস্থার কারণে ঠিক মতো দোকানটিও চালাতে পারেনি। আর এই দিকে পৃথিবীও তাদের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল।

জোড়া বোনের দুঃসহ জীবন, মাতালদের স‌ঙ্গে রাত কাটাতে পাঠাতেন মা - the Bengali Times
আমেরিকার এক পরিচালক টড ব্রাউনিং তাদের জীবনী নিয়ে একটি মুভি বানিয়েছেন

সেসময় তাদের জীবনে শুরু হয় আবার অর্থকষ্ট। এরপর ১৯৬১ সালে এক দোকানদার তাদেরকে কাজ দেন। আসলে সে দোকানদার ডেইজি এবং ভায়োলেটকে খুব পছন্দ করতো। তিনি ডেইজি এবং ভায়োলেটের জন্য একটি বিশেষ চেয়ার বানিয়েছিলেন, যাতে তাদের বসে কাজ করতে কোনো কষ্ট না হয়। আসলে সেই দোকানদার তাদেরকে ক্যাশিয়ারের কাজ দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে এই দুই বোন তিনদিন টানা কাজে না আসলে সেই দোকানদার ডেইজি এবং ভায়োলেটের বাড়িতে যায়।

সেখানে গিয়ে দরজায় শব্দ করে, কিন্তু তারা দরজা খোলেনা। দরজা না খোলায় তিনি ভয় পেয়ে যান। তারপর সে পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে দেখে ডেইজি এবং ভায়োলেট অবশেষে কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে। একইসঙ্গে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় দুজনে। তারপর তাদেরকে একইসঙ্গে একটি কফিনে দাফন করা হয়। তবে ফরেনসিক তদন্ত অনুযায়ী জানা যায়, ডেইজি প্রথমে মারা যায়। আর ভায়োলেট ডেইজি মারা যাওয়ার দুই থেকে চারদিনের মধ্যে মারা গিয়েছিল। কিন্তু ভায়োলেটকে সেসময় সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না। সেসময় তারা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকতেও পারেনি। ধুঁকে ধুঁকে মারা যেতে হয়েছে তাদের।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles