
আমার নরওয়েজিয়ান বন্ধুর ফোন- কাহা করো কী?
– ইকটু শুইছি..
– ঝিমাও?
– হু
– মেজাজ খারাপ? টিকা পাইছো?
– না
– কবে পাবা? বাংলাদেশের মানুষের টিকা দেওয়া শ্যাষ আর তোমরা টাকা পকেটে নিয়ে কাঙালের মতো ঘুরতেছো
– তোরা পাইছিস?
– না কাহা.. বয়স হয় নাই
– বুড়া হওয়াই দেখি ভালো ছিল!
– কবে বুড়া হবা আর কবে নিবা? তোমার দ্যাশে যাওয়াও তো আটকায়ে গেলো!
– যে খরচ রে..
– লোকজন দ্যাশের টাকা মাইরে তোমাদের ওকিন খরচ করতি যায়, আর তোমরা কও ট্যাকা নাই?
– মানুষ ক্যামনে টাকা জমায় রে?
– ইশকুরুপ টাইট মারো। খাওয়া কমাও, টিভি দ্যাখা কমাও, ঘুরাঘুরি, আউল খরচ কমায়ে ফেলো। দাওয়াত-ফাওয়াত বাদ দি ঘরে মটকা মাইরে পইড়ি থাহো। ট্যাকা না জমলি আমার নামে ছাগল পুইষো কলাম!
ব্যাটা কথা খারাপ বলে নাই। মনে ধরলো।
মেজাজ-মর্জি আসলেই ভালো নাই। বিপদ যখন আসে, মামা-চাচা, শালা-সুমন্ধি নিয়েই আসে। গাড়ির ইঞ্জিন সাইন জ্বলে উঠছে, কয়শো ডলারের মামলা আল্লাহই জানে। ওদিকে কয়েক সপ্তাহ হলো ক্যামেরার প্রাইম লেন্স নষ্ট করে ফেলেছি। ছবি তোলা বন্ধ। সোফার উপর খুলে রাখার পর গড়িয়ে সোজা মেঝের উপর। বাকি যে দুইটা আছে, সেগুলা দিয়ে হয় পাঁচশো গজ দূরের ছবি, নয়তো খুব কাছের পিঁপড়ার ছবি তোলা যায়। এর মাঝামাঝি তোলার উপায় নাই। দোষ আমার। অনেক অবহেলাও করছি। ভয়াবহ ঠান্ডা, ঝড়, স্নো’র মধ্যে ছবি তুলতে গেছি লেকের ধারে বেকুবের মতো।
বন্ধুর কথামতো টাইট দেওয়া শুরু করলাম।
বাচ্চা দুইটাকে ডাক দিয়ে সামনে দাঁড় করিয়ে বললাম, তোরা যে ঐ ঘর ছেড়ে এখানে আসলি, ঐ ঘরে এখন কে আছে?
– কেউ নাই, ভুত!
– লাইট, কম্পিউটার বন্ধ করে আসছিস?
– না
– যে মানি ওয়েস্ট করে, সে কার ব্রাদার জানিস?
– না
– ডেভিলের। আজকে থেকে গেম্স্ কার্ড কিনা, পিজা খাওয়া, চিকেন ফ্রাই খাওয়া বন্ধ। এই মাসে এক্সট্রা পঞ্চাশ ডলার মোবাইল ডাটা বিল কেন? তোদের বলি নাই ওয়াই-ফাই ইউজ করবি? কে ট্যাবের ডাটা ইউজ করছিলি রে?
– [দুইজনই মাথা নাড়ায়]
কিছুক্ষন আগে আমাজন থেকে আইপি টিভির রিমোট ডেলিভারি দিয়ে গেছে। তাদের দেখিয়ে বললাম, এটা কী?
– রিমোট!
– এর কাজ কী?
– চ্যানেল চেঞ্জ করা
– এ পর্যন্ত কয়টা রিমোট কেনা হইছে?
– চারটা
– পাছার তলার ফেলে আগেরটা ভাঙছিস। এইবার যদি ভাঙিস আর কিনবো?
– না
– টাকা কি গাছ থেকে আসে?
– না
– কোথা থেকে আসে?
– ব্যাংক থেকে
– আচ্ছা যা।
দুষ্টু দুইটা যাবার সময় টিভি, লাইট অফ করে খিলখিল হেসে দৌড়ে পালালো। আমি অন্ধকারে ডুবে গেলাম।
এবার গিন্নিকে ডাক দিলাম, কোই গেলা?
– বলো
– এইটা কী
– হাত
– আরে বাবা, হাতের মধ্যে কী?
– রিমোট ছাড়া তো আর তো কিছু দেখছি না। না কি ম্যাজিক করে টাকা পয়সা লুকায়ে রাখছো?
– এটার কাজ টিভি চালানো, চ্যানেল চেঞ্জ করা তাই না?
– ভলিউম কমানো বাড়ানো, অন অফ করা যায় না?
– কিন্তু তোমরা সবাই কী করো?
– গা চুলকাই, মাথা আঁচড়াই, চোখ ডলি, চায়ের কাপের চিনি গুলাই আর অযথা হাতে নিয়ে বসে থাকি; কারেক্ট?
– বাচ্চাদের পড়ানোর সময় দেখলাম ওটা দিয়ে মারতেছো। সেদিন দেখলাম হাতে নিয়ে ঘুমাচ্ছ
– কবে?
– ঘুমালে কেমনে বুঝবা? আমার ফাইনাল কথা, এটাই শেষ। পিঠ চুলকানির জন্য চুলকানি কিনে দেই নাই? আর কোনো রিমোট কেনা হবে না!
– তুমি রিমোট কিনবা না তো আমার কী?
– আজকে থেকে রান্না করবা সন্ধ্যা সাতটার পর অফ পিক আওয়ারে। আগেরদিনেরটাও অগ্রিম রান্না করে রাখবা। একটার বেশি আইটেম নিষেধ। বাচ্চারা খাইলে খাবে, না খাইলে নাই। খিদের নাম বাবাজি..
– তাহলে কালকের খাওয়ার আজকে রাঁধবো?
– একই কথা। মানুষ খায় কেন জানো?
– বাঁচার জন্য? অথচ আমরা বাঁচি খাওয়ার জন্য; তাই তো?
– হু
– ওকে চান্দু। তোমার কথা ফাইনাল।
বিকাল তিনটায় গিন্নি ডাক দিলো, চান্দু দেখে যাও বৃষ্টি হচ্ছে!
আমি উচ্ছসিত হয়ে লেপ ফেলে থেকে দৌড়ে গেলাম বাইরের ঘরে, বললাম কোই কোই!
– ঐ যে?
– এ তো স্নো?
– ঐ একই। মেঘ থেকে বৃষ্টির ফোটা নামার সময় ঠান্ডায় জমে স্নো হয়। তোমার পিজা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে
– বানাইছো?
– ক্যামনে! দুপুরে চুলা বন্ধ। তাই অনলাইনে অর্ডার করছি। ‘পিৎজা পিৎজা’ থেকে পিজা আর ‘পোপেইজ’ থেকে চিকেন ফ্রাই। সাইড ডিশটা দারুন! তোমারও পছন্দ, তাই না চান্দু!
– কয় ডলার লাগলো?
– শোনো চান্দু, অতো টাকার হিসাব করো কেন? তুমি বিড়ি সিগারেটও খাও না, লটারির টিকিটও কিনো না, মদ গাঁজাও খাও না। তোমার কিপ্টামি করার দরকার আছে? তোমার লেন্স আমি কিনে দিবো, ঠিক আছ? আল্লাহ তায়ালার কাছে শোকর করো যে আমরা এখনো বেঁচে আছি। তুমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্চো। তোমার কিসের ভয়?
চিশতীকে ফোন দিলাম। দোস্ত, লোকজন খালি খোটা দেয়; দুনিয়ার মানুষ টিকা পায়, আমরা কেন পাই না
– আমি তো টিকাই নিবো না। কপালে মৃত্যু থাকলে হবেই। টিকা যত দেরিতে আসবে তত লাভ। এক বছর কত আরামে আছি। বৌ মার্কেটিং-এ যায় না, ছেলে-পেলের জ্যাকেট, জুতা, সাইকেল কিচ্ছু কিনতে হয় নাই। ঘরের মধ্যে ছেঁড়া-ফাটা জামা পরে ঘুরতেছে। ক্যাম্পিং, দাওয়াত কিচ্ছু করতে হয় নাই। টরন্টোতে মাসে চারবার দাওয়াত খাওয়ানো আর আটবার দাওয়াত খাইতে যাওয়াতে মাসে কমপক্ষে হাজারখানেক ডলার লাগে। এই শহর হইলো দাওয়াতের লীলাভূমি। বৌয়ের শাড়ি, জামা, লিপস্টিক, স্যান্ডেল, মাশকারা কিচ্ছু কিনতে হয় নাই
– তাই তো!
– লকডাউন তুললেই খরচ সুদে আসলে তুলবে
– আমার পোলাপান তো আমাজানের পাসওয়ার্ডও জানে
– তাইলে? আল্লাহ ভরসা। টিকার খ্যাতা পুরি..
– মরলে মরবো.. দুই দিনের দুনিয়ায়..
– এই যে..তোর ভাব উঠতে সময় লাগে না। বাইডেন কে দেখ। আটাত্তর বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট হইছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প চুয়াত্তর বছর বয়সে আবার চার বছর পর ইলেকশনে দাঁড়ানোর পায়তারা করতেছে। মানুষের মরার কত দেরি দেখছিস? আচ্ছা, তোর সাথে জরুরি কথা ছিল..
– বল
– আমার বাগান কোপানোর একটা জোগাল দরকার। গত বছরে কোপাইছিলো সেই ডালমIর কে আনতে পারবি?
– দোস্ত, ও মারা গেছে
– ইন্নালিল্লাহ.. ক্যামনে!!
– করোনায়।
আমরা দুজন বেশ কিছুক্ষন চুপ থাকি। সে হঠাৎ বলে উঠে-
– রিপন
– বল
– টিকা নেয়া জরুরি হয়ে পড়ছে রে..। ভাবছিলাম নিবো না। ভুল চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু দ্যাখ আল্লাহ তায়ালা এতো উদাহরণ দিচ্ছে মৃত্যুর, তাও আমাদের হুশ নাই। আমরা দেখেও না দেখার, শুনেও না শোনার ভাণ করতেছি। লক্ষ লক্ষ মৃত্যু দেখেও গোঁয়ারের মতো টিকা না নেয়ার চিন্তা করা মানে আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত অস্বীকার করা। আল্লাহ বুদ্ধি দিছে, উপায় দিছে। টিকা না নিয়ে মরলে পরকালে কী উত্তর দিবো? ওই গুনাহ’র কোনো মাফ নাই
– ঠিক! ডালমার এর পরিবার মহা সঙ্কটে পড়ছে রে.. সেও শুধু বলতো টিকা নেয়ার দরকার নাই, তার না কি কিচ্ছু হবে না
– কী মারাত্মক ভুল!
– ঠিক বলছিস!
– আগে ছিলাম বোকা..
আমি বিত্ত-দখিনা কে ডাক দিলাম, কোই তোরা এইদিকে আয়।
তারা দৌড়িয়ে এসে বলল, আমরা লাইট কম্পিউটার বন্ধ করছি
– গুড! চল টিম হর্টন্স থেকে কফি আর মাফিন কিনে আনি? বিত্ত কী খাবি?
– প্ল্যান্ট বেজড বার্গার!
– আর দখিনা?
– চকলেট চিপ মাফিন
– আর তুমি?- গিন্নিকে জিজ্ঞেস করি
– ব্রকলি স্যুপ আর কফি!
– চলো! ডবল মাস্ক পড়বি সবাই! তোরা গাড়িতেই বসে থাকিস, আমি নিয়ে আসবো..
আমরা সবাই মহা আনন্দে রেডি হতে থাকি।
***[ আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে WHO কোভিড-১৯ ভাইরাস কে বিশ্ব মহামারী ঘোষণা করে। আজ পর্যন্ত প্রায় ছাব্বিশ লক্ষ মানুষ মারা গেছে। আসুন আমরা সবাই টিকা নেওয়া সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করি, উৎসাহিত করি I আমরা কেও আর আপনজন হারাতে চাই না]