প্রতারণার ফাঁদে ফেলে শুধু যশোর জেলা থেকে ৪শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এহসান সংস্থা। হালাল উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে যশোরের ১৬ হাজার মানুষকে। প্রতারণা চক্রে সংস্থার চেয়ারম্যান মুফতি আবু তাহের নদভীসহ ১৯ জনের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
এসব টাকা আত্মীয়স্বজনের নামে গড়া কাগুজে প্রতিষ্ঠানে সরিয়েছে কোম্পানির চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীরা। হালাল উপার্জন এবং উচ্চ মুনাফার প্রলোভনে পড়ে এহসান সংস্থার তিনটি প্রতিষ্ঠানে টাকা দিয়েছিল যশোরের ১৬ হাজার মানুষ। অধিকাংশ রেখেছিলেন শেষ বয়সের পেনশনের টাকা। জীবনের শেষ দিনগুলো কিছুটা স্বস্তিতে কাটাতে শেষ সম্বল বিক্রি করে টাকা দিয়েছিলেন এহসান সংস্থায়। কিন্তু স্বস্তির সেই চাওয়া আজ দুঃসহ জীবন নিয়ে এসেছে।
দোকান আর জমি বিক্রি করে এহসান সংস্থায় টাকা রাখা যশোরে বৃদ্ধ নুর ইসলাম মিয়া বৃহস্পতিবার বলেন, বাজারে একটি দোকান আর এক টুকরো জমিতে সংসার চলত। কিন্তু এহসান গ্রুপ হালাল উপার্জনের কথা বলে দোকান আর জমি বিক্রি করিয়ে তিন লাখ টাকা নেয়। কয়েকদিন মুনাফা দিয়ে তারপর বন্ধ করে দেয়। করোনায় মানুষের কাছ থেকে হাত পেতে পেটের ভাত জুগিয়েছেন। কিন্তু খেয়ে, না খেয়ে আর টাকার শোকে পা অবশ হয়ে যায়। কয়েক মাস ধরে চোখেও দেখতে পাচ্ছেন না। শেষ জীবনে হালাল উপার্জন খেয়ে মরতে চেয়ে এহসান গ্রুপে টাকা রেখে এখন না খেয়ে মরতে হচ্ছে।
পিবিআইয়ের যশোর জেলার পরিদর্শক একেএম ফসিহুর রহমান বলেন, যশোরের একই অফিসে এহসান গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান চালাত। তারা পরিকল্পিতভাবে মানুষকে হালাল উপার্জন ও উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের টার্গেট ছিল ইসলামমনস্ক মানুষ। যারা হালাল উপার্জনে জীবন চালাতে চায়। প্রতারিত হওয়া মানুষের একটি বড় অংশই শেষ জীবনের পেনশনের টাকা এহসান সংস্থায় রেখেছিল। শেষ সম্বল হারিয়ে অনেকেই নিঃস্ব।
যশোর পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এহসান সংস্থা যশোরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। দেড় হাজার গ্রাহক প্রতারিত হওয়ার প্রাথমিক প্রমাণ তারা পেয়েছে। আসামি গ্রেপ্তার হয়ে জামিনও পেয়েছে।
‘যশোর এহসান ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক সংগ্রাম কমিটির’ সাধারণ সম্পাদক মফিজুল ইসলাম ইমন বৃহস্পতিবার বলেন, প্রতারকদের মূল টার্গেট ছিল ৬০ থেকে ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ। অধিকাংশই পেনশনের টাকা ব্যাংক থেকে তুলে এহসান সংস্থায় বিনিয়োগ করেছিলেন। তার বাবাও একজন ভুক্তভোগী। তার বাবা ১৬ লাখ টাকার জমি বিক্রি করেছিলেন।
যেদিন জমিটি বিক্রি করেন তার পরের দিন মসজিদের নামাজ পড়ে বের হওয়ার সময় সংস্থার লোকজন তার বাবাকে বলেন, টাকা ব্যাংকে রাখলে হারাম আয় হবে। শেষ বয়সে এসে হারাম আয় খেয়ে জাহান্নামে কেন যাবেন। এরপর তার বাবাকে ফুসলিয়ে টাকা এহসান সংস্থায় বিনিয়োগ করানো হয়। কয়েকদিন মুনাফা দিলেও হঠাৎ করেই বন্ধ করে দেয়। তার বাবার মতো শুধু যশোরেই ১৬ হাজার মানুষ প্রতারিত হয়েছে। সারাদেশে প্রায় তিন লাখ গ্রাহকের আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে চক্রটি। শেষ বয়সে এসে শেষ সম্বল প্রতারণার মাধ্যমে শেষ হয়ে যাওয়ায় অন্তত ৬৭ জন গ্রাহক শোকে মারা গেছে।
টাকা চাইতে গেলে মামলায় ফাঁসিয়ে দেয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তিনি যশোরসহ প্রতারিত ৩৯টি জেলার মানুষকে সংগঠিত করে টাকা আদায়ের জন্য কাজ করছেন। এজন্য তাকে একাধিক মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। একটি মামলায় তিনি এক মাস জেলও খেটেছেন।
যশোরে গ্রাহক নুর ইসলাম মিয়ার দায়ের করা একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গত সপ্তাহে জমা দিয়েছে পিবিআই। তদন্তে ১৯ জনের অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। তারা পূর্বপরিকল্পিতভাবে মানুষকে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অভিযুক্তরা হলো এহসান সংস্থার চেয়ারম্যান মুফতি আবু তাহের নদভী, ব্যবস্থাপক কাজী রবিউল ইসলাম, জিএম জুনায়েদ আলী, পরিচালক আজিজুর রহমান, মঈন উদ্দীন, মুফতি গোলাম রহমান, পরিচালক আবদুল মতিন, আমিনুল হক, কলিমুল্লাহ কলি, মিজানুর রহমান, মুফতি মা. ইউনুস আহম্মেদ, মনিরুল ইসলাম, আইয়ুব আলী, হালিম, শামসুজ্জামান, আতাউল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম, মোকসেদ আলী ও মুফতি ফোরকান আহমেদ।
পুলিশের তদন্তে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারী সকলেই বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় কর্মরত। তারা সুন্নতি পোশাক পরিধান করে ইসলামী লেবাসে মানুষকে সুদমুক্ত বিনিয়োগের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেয়। সরল বিশ্বাসে মানুষ তাদের কাছে টাকা বিনিয়োগ করলে টাকা আত্মসাৎ করে।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, একই অফিসে প্রতারকরা তিনটি প্রতিষ্ঠান চালাতেন। শুধু প্রতারণার জন্য তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলেন। ২০০৮ সালে এহসান ইসলামী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। একই অফিসে এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলমেন্ট নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান করা হয় ২০১০ সালে। এরপর করা হয় এসহান ইসলামী ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি। একই অফিসে ভিন্ন ভিন্ন নামে অফিস গড়ে তোলার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন পলিসিতে মানুষকে প্রতারণা করা।
সূত্র : আমাদের সময়