
শ্রদ্ধা জানাই আমার প্রয়াত মা রিজিয়া বেগম ও প্রিয় বোন কামরুন নাহারের প্রতি।
নারীদের সম্মান, মর্যাদা বা তাদের উৎসর্গের স্বীকুতি প্রতিদিনের কাজ। আজ আমি দুইজন নারীকে স্বরণ করতে চাই। একজন জীবিত এবং অন্য জন মৃত। আমার মরহুম মা, যিনি অন্যান্য সকল মায়ের মত সব কাজ করছেন। তবে আমি বিশেষভাবে তার কাছে ঋণী আমার জীবনের সংগঠন, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষার জন্য, যা কিনা এখনো কাজে লাগছে।
তার করণীয় অসংখ কাজের মধ্যে আমি পিক করতে চাই আমাদের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার ভূমিকাকে।
আমার বাবা তখন ঝিনাইদহ শহরের কোর্টে পুলিশ অফিসার হিসাবে কর্মরত। হটাৎ ওই শহরে পাক সেনাদের আক্রমণ। আমার বাবা দ্রুত আমাদের বাসায় এসে আমাদের ছোট দুই ভাইবোন এবং মাকেসহ প্রতিবেশী বেশ কিছু লোকজনকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে রওনা হলেন। অন্তত ৩০/৪০ জন লোক। তার কাছে তখন শুধুমাত্র একটি ৩০৩ রাইফেল। আর কিছুই না। মা বেরিয়েছিলেন জাস্ট এক কাপড়ে। যাহোক এইভাবে ৩ দিন তিন রাত হাটা, দৌড়নো এবং বোনে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে আব্বা আমাদেরকে আমাদের গ্রামের বাড়ি রেখে গ্রামের বেশ কিছু ছেলেদের নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে। ফিরে এসেছিলেন যুদ্ধ শেষে। মা তখন প্রেগনেট ছিলেন।
যে বিশেষ মুহূর্তির কথা বলতে চাই তা হলো। পথি মধ্যে কোন এক রাতে আমরা সহ অনেক লোক কোনো এক গ্রামের এক চেয়ারম্যানের বাড়িতে রাত্রে আশ্রয় নেই। ওখানে অনেক লোক থাকায় আমাদের জায়গা হয়েছিল গোয়াল ঘরে। সেখানে কিছু খড়কুটো বিছিয়ে তারপর আমাদেরকে ঘুমাতে দেওয়া হয়েছিলো। রাতে যখন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিলো তখন আমার মা শুধুমাত্র তার পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে তার শাড়িটি দ্বারা আমাদের দুইভাইবোনসহ আরো দুটি বাচ্চাকে ঠান্ডার থেকে বাঁচার জন্য আমাদের গায়ে সারারাত দিয়ে রেখেছিলেন। এই হলো আমার “মা” এবং পৃথিবীর সব মায়েরাই এমন। এই ভালোবাসা, বন্ধন, দায়িত্ব বা অন্তরের টান যাই বলেন না কেন, এর দাম হাজার বার জন্মিয়ে হাজার বছর ধরেও শোধ দেওয়া যায় না। আল্লাহ উনার আত্মার শান্তি দিন। ওই সময় অনেক ছোট থাকলেও মায়ের মুখ থেকে এই কথা অনেকবার শুনেছি, এবং এসময় সে কষ্টের নয় বরং গর্বের সাথেই সে তার দায়িত্ব পালনের কথা বলতেন।
এবার আসি আমার বড়ো বোনের কথায়। সে অতি সরল, ধর্মভীরু এবং পরিষ্কার মনের একজন মানুষ। সে বলতে গেলে ছিলো আমাদের দ্বিতীয় মায়ের মত। সে আমি এবং আমার পরে যে বোনগুলি জন্মেছিলো তাদের সবাইকে লালন পালন করেন। এবং আব্বাবার অর্থনৈতিক হিসাবও সে দেখতো। আমাদের জামা কাপড়, বাজার-ঘাট ইত্যাদি সব দেখাশুনা করতো। তার একটি ছেলে আছে, তবে সে তার ছেলে এবং আমাদেরকে কখনো আলাদা করে দেখে না। এমনকি আমার চাচাতো ভাইবোনকেও সে একই রকম জানে। আমাদের ছোট বেলায় সে কোনো বাসায় বেড়াতে গেলে, যদি তাকে কিছু খেতে দেওয়া হতো, সে তার থেকে কিছু আমাদের জন্য নিয়ে আসতো। আমরা এবং আমাদের চাচাতো ভাইবোনদেরকে নিয়ে সেই ক্ষুদ্র জিনিস অতি আনন্দে উপভোগ করতাম।
যে কোনো মানুষে র্প্রতি তার অগাধ মায়া এবং ভালোবাসা। ছোটবেলায় দেখতাম বাড়ির পাশ দিয়ে যদি অপরিচিত কোন ব্যাক্তির লাশ দাফন করতে নিয়ে যেত তাহলেও তার চোখে পানি আসতো।
অত্যান্ত বড়ো মনের মানুষ, নিজের শেষ করে হলেও অন্যকে সাহায্য করবে।
তার একটি ফানি ঘটনা বলে শেষ করি। আমাদের বাড়িতে অনেক আগে একবার ডাকাত এসেছিলো। সে সময় ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যায়। তখন সে ডাকাতদের মধ্যে ছোট একজন ছেলেকে বলে আমাকে একটু পানি দিন। সেই ডাকাত ছেলেটি তাকে আমাদের কিচেন টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি এনে তাকে দেয়। পানি পান করার ঠিক আগ মুহূর্তে সে ডাকাত ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, “ভাডি পানির মধ্যে বিষ মিশাওনি তো ?”. ছেলেটি তাকে এক ঝাড়ি মারলে সে সঙ্গে সঙ্গে একবারে পানি পান করে নেয়। এই রকম একজন সরল লোক সে।
আজকের দিনটিতে তাই আমি তাকেও স্মরণ করতে চাই। আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ রাখেন এবং দীর্ঘায়ু দান করেন।
ছবি পোস্টে উনারা দুজনই কনসারভেটিভ তাই তাদের ছবি এখানে দিচ্ছি না।
সবাই ভালো থাকুন এবং মা-বোন, স্ত্রী সবাইকে তাদের যথাযথ সম্মান দিন।
স্কারবোরো, অন্টারিও, কানাডা