
আমার বর্তমান শহর টরন্টো। এই শহরের পাবলিক লাইব্রেরিটি বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছে। খ্যাতি চাকচিক্যের জন্য নয়, সেবার কারণে। শহরের কেন্দ্রস্থল ইয়ং স্ট্রিটে লাইব্রেরিটির রেফারেন্স সেকশন। কিছুদিন আগে সেখানে প্রথমবারের জন্য গেলাম। সেখানে কেমন সেবা পেলাম তা নিয়েই আজকের এ লেখা। সঙ্গে থাকবে লাইব্রেরিটির সঙ্গে আমার দুই বছরের অভিজ্ঞতার কথাও।
কেউ কেউ হয়তো বলবেন, কানাডায় এত কিছু থাকতে আমি কিনা লাইব্রেরি নিয়ে পড়লাম! কেউ বলবেন, মহাশয় পণ্ডিত ব্যক্তি, তাই পুস্তক আর পুস্তকাগারের প্রশংসা করেই কানাডার গুণগান করেছেন। পণ্ডিত কিনা জানি না, কিন্তু সারা জীবন বইয়ের সংস্পর্শে থেকেছি। বইয়ের প্রবাহ ভালো থাকলে আরও অনেকের মতো আমারও অনেক দুঃখ দূর হয়ে যায়। তাই বই আর লাইব্রেরি বিষয়টা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের। ঢাকাতে নিজের বাসার পাঁচ হাজার বইয়ের সংগ্রহ ছেড়ে আসার যে কষ্ট সেটা আর কে দূর করতে পারত? বই নিয়েই আমার জীবন গড়া, আর তাই লাইব্রেরি নিয়েই কথা বলা। এতেই আনন্দ, এতেই যেন স্বর্গলাভ।
একটা প্রশ্নের উত্তর শুরুতেই দিয়ে রাখি। প্রশ্নটি হলো রেফারেন্স লাইব্রেরিতে যেতে আমার এত দেরি হলো কেন। প্রবাসজীবনের শুরু থেকেই তো বইয়ের পেছনে ছোটা যায় না। শুরুতে তো ছুটতে হয় থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তার পেছনে। এরপর বছর খানেক ধরে কানাডাতে আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা ইংরেজি পাণ্ডুলিপি বানালাম। বছর দেড়েক পরে স্থিত হলাম নতুন একটি বাংলা বই লেখার ব্যাপারে। বিষয়টি শ্রীচৈতন্যদেব। লাইব্রেরির ওয়েবসাইটে খুঁজে পেলাম দরকারি বেশ কটি বই। সেগুলোর পাঁচটির শুধুমাত্র একটি করে কপি আছে। অর্থাৎ সেগুলো কোনো পাঠককে বাসাতে নিতে দেওয়া হবে না। ব্যবস্থা অনুযায়ী সেগুলো রেফারেন্স লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখতে হবে।
সে বই দেখতে কী করতে হবে? সাইটে গিয়ে দেখলাম স্ট্যাক করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। স্ট্যাক করলে ওই বই নির্দিষ্ট জায়গাতে এনে রাখা হবে। পরামর্শ মতো বাসা থেকে স্ট্যাক করে সাবওয়ে ধরে রেফারেন্স লাইব্রেরিতে গেলাম। ঢুকে তো আমার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। ছয়তলা ভবন। মাঝখানে উন্মুক্ত। ওপর থেকে নিচে, নিচ থেকে ওপরে পুরো ভবনটা দেখা যায়। চারপাশে সাজানো শত শত আলমারি। স্ট্যাক করার সময় নির্দিষ্ট করে দিতে হয় কোথায় আমার বই থাকার কথা দোতলার সেলফে। দোতলায় উঠে গিয়ে ইনফরমেশনে জানতে চাইলেই একজন উঠে এসে দেখিয়ে গেলেন কোথায় আমার বই রয়েছে।
পাঁচটার মধ্যে দুটি ইংরেজিতে লেখা, তিনটি বাংলায়। একটি নিউইয়র্ক, একটি মুম্বাই, তিনটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত। এমন সব বই সুদূর কানাডাতে এসে লাইব্রেরিতে দেখতে পাব ভাবিনি কখনো। কাজ শেষ করে, বই যেখান থেকে নিয়েছি সেখানে নিয়ে রাখতে কবে। রাখতে গিয়ে ইনফরমেশনে যিনি ছিলেন তাকে ধন্যবাদ দিতে গেলে তিনি আমাকে বললেন, বইগুলো আবার আমার দরকার হবে কি না। আমি হ্যাঁ বলতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, পরদিনই যেতে পারব কিনা। আমি আবারও হ্যাঁ বলতে তিনি আমাকে জানালেন, ২৪ ঘণ্টার জন্য বইগুলোতে আলাদা টাগ লাগিয়ে রাখা হবে যাতে সেগুলো কেউ না সরান। বলেই কাজটি করে যথাস্থানে রেখে দিলেন। আমি নাচতে নাচতে বাসাতে ফিরলাম।
টরন্টো লাইব্রেরির ডজ রোড শাখার কর্মী এডিথ লেখকের কাছে ব্যাখ্যা করছেন কীভাবে হোল্ড কাজ করে
কানাডাতে আমার অনেক প্রাপ্তির অন্যতম হলো টরন্টো শহরের এই পাবলিক লাইব্রেরিটি। ২০১৩ সালের আগস্টে এসে কিছুদিনের মধ্যেই লাইব্রেরির সদস্য হই। বাসার কাছে শাখাটি হলো ডজ রোড ব্রাঞ্চ। সদস্য হতে গিয়ে সে কী আনন্দ! ওরা শুধু একটি পরিচয়পত্র দেখতে চাইল। সর্বমোট দশ মিনিটেই হয়ে গেল পরিবারের তিন সদস্যের তিনটি লাইব্রেরি কার্ড। কোনো পয়সা লাগল না। কোনো সদস্য ফি লাগে না জেনেও স্টাফকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি হাসলেন। হাতে দিলেন কিছু কাগজ, যাতে নিয়মকানুন লেখা আছে। জানালেন প্রতি সদস্য একবারে ৫০টি আইটেম বাসাতে নিতে পাবে। শুনে তো আমার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি থেকে শুধুমাত্র অধ্যাপকেরাই অনেকগুলো বই বাসাতে নিতে পারতেন জানতাম। এখানে দেখছি শহরের লাইব্রেরি থেকে সকল মানুষেরই জ্ঞানচর্চার অবাধ সুযোগ রাখা রয়েছে।
সারা শহর জুড়ে লাইব্রেরিটির ১০০টি শাখা। সবকটি শাখা মিলে মোট ১ কোটি ২০ লাখ বই, সিডি বা অন্যান্য আইটেম রয়েছে। ইংরেজি ছাড়াও রয়েছে চীনা, জাপানি, হিন্দি, তামিল, রুশ, ইতালিয়ান, আরবি, স্প্যানিশ, জার্মানসহ মোট ৬৫ ভাষার বিপুল সংগ্রহ। যথেষ্ট বাংলা বইয়ের সংগ্রহও আছে কোনো কোনো শাখায়। যেকোনো একটি শাখাতে সদস্য হলেই সবকটিতেই প্রবেশ উন্মুক্ত হয়। যেকোনো শাখা থেকেই বই আনা যায়, আবার যেকোনো শাখাতে ফেরতও দেওয়া যায়।
লাইব্রেরির ওয়েবসাইটে যোগাযোগের অনেকগুলো মাধ্যম দেওয়া আছে। সেখানে গিয়ে প্রয়োজনে চ্যাট অপশনে গিয়ে দরকারের কথা আলাপ করা যেতে পারে সহজেই। ইমেইল করলেও আপনি উত্তরের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। ফোন করলে তো কথাই নেই।
মজার ব্যাপার হলো এখানে লাইব্রেরিতে বই আনতে গেলে কোনো স্টাফ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে না বা প্রিয়জনের সঙ্গে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত থাকে না। সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত অনুসন্ধানে ওরা পাঠককে সাহায্য করে। লাইব্রেরির ওয়েবসাইট দেখে অন্য কোনো শাখার কোনো বইয়ের দরকারের কথা জানালে কর্তৃপক্ষ আমার পছন্দ মতো শাখাতে সেটি পৌঁছে দিয়ে আমাকে মেইল করে নিয়ে আসতে। প্রক্রিয়াটি হোল্ড নামে পরিচিত। শুধু কী তাই? বয়স বা অসুস্থতা কোনো কারণে কেউ তিন মাস বাড়িতে আটকে থাকলে লাইব্রেরির লোকেই তার পছন্দের বই বিনা খরচে বাসাতে পৌঁছে দিয়ে যায়।
প্রতিটি শাখাতে ছোটদের জন্য আলাদা জায়গা আছে। যে শিশু আগামী দিনে দেশ পরিচালনায় ভূমিকা রাখবে তার বিকাশে বইয়ের সহজলভ্যতাকে নিশ্চিত করাকে জরুরি বিবেচনা করে তাদের প্রয়োজনের সব বই যেন এনে রাখা হয়েছে লাইব্রেরিতে। এ ছাড়া প্রতিটি শাখাতে রয়েছে হরেক রকম অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা। যেমন আছে নতুন ইমিগ্রান্টদের জন্য বিনা খরচে ইংরেজি শেখার ব্যবস্থা, তেমনি আছে বিভিন্ন রকমের সেমিনারের আয়োজন। দরকারে লাইব্রেরিতে বসে অনলাইন কাজও করতে কোনো অসুবিধা নেই। এ ছাড়া সারা বছর ধরে প্রতি শনিবার সকালে লাইব্রেরির সদস্যদের আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে বিনা পয়সায় কিছু টিকিট দেওয়া হয় টরন্টো আর্ট মিউজিয়াম, সায়েন্স মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা প্রভৃতি জায়গায় যাওয়ার জন্য। যে টিকিটগুলোর দাম সাধারণভাবে ৩০-৪০ ডলার।
লেখকদের জন্য পাঠ-এর ব্যবস্থাও রয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি মাস থেকে লেখালেখি করার সুবিধার্থে লেখকদের জন্য বিশেষ নির্জন ঘরের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। রেফারেন্স শাখাতে একজন লেখক এক নাগাড়ে তিন মাস ধরে ব্যবহার করতে পারেন সে ঘর।
১৮৩০ সালে মেকানিক্স ইনস্টিটিউটে প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরি যা এখন টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরি নামে পরিচিত তার সেবা-ব্যবস্থা এত ব্যাপক যে, আমি নিশ্চিত সেগুলোর অনেকগুলো আমার এখনো জানা হয়নি। লাইব্রেরির ওয়েবসাইট বলছে প্রতি বছর ১ কোটি ৮৫ লাখ মানুষ লাইব্রেরিতে যান এবং ৩ কোটি ২০ লাখ বই এবং অন্যান্য জিনিস তারা লাইব্রেরি থেকে ধার নিয়ে থাকেন।
স্বর্গসুখ লাভের জন্য অধিক আর কী-ই বা প্রয়োজন একজন পাঠকের! একজন নতুন অভিবাসী হিসেবে কানাডাকে কৃতজ্ঞতা জানাই দেশটিতে আমাদের জায়গা দেবার জন্য। তাকে অধিক কৃতজ্ঞতা বিনা খরচে একটি লাইব্রেরি ব্যবহার করতে দেবার জন্য।
ইস্টইয়র্ক, অন্টারিও, কানাডা