“আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।”
জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার পংক্তি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের ট্যুর পরিকল্পনার প্রথম পছন্দের জায়গাটা বেছে নিয়েছিলাম বান্দরবনের মারায়ংতং পাহাড়।
সবুজে ঘেরা উঁচু-নিচু পাহাড়, গাঁ শিউরে ওঠার মতো পাহাড়ের বাক, শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় আকার মত প্রকৃতি দেখে মনে হতে পারে যে খোদা তার সমস্ত কারুকার্য এখানে নিপুন ভাবে নিজ হাতে একেছেন। দেশের অনেক জায়গা ভ্রমন করেছি অনেক লুকায়িত সৌন্দর্য্য দেখে বার বার মুগ্ধ হয়েছি কিন্তু বরাবর একটা আকাঙ্খা থেকে গিয়েছিল একটা রাত পাহাড়ের সাথে কাটানোর।
সেই সূত্র ধরেই, যেই জায়গাটার কথা প্রথমেই মাথায় এসেছে সেটা হচ্ছে বান্দরবনের মারায়ংতং পাহাড়। যদিও সময়টা গ্রীষ্মের আগমন আর শীতের প্রস্থান, এমন একটা সময়। সেই সাথে সেমিস্টার ব্রেকের ছুটি। আমরা পাঁচ বন্ধু বেরিয়ে পড়লাম সেই সুপ্ত ইচ্ছার দিকে যেটা দিনের পর দিন আমাদের মনে কষাঘাত করে যাচ্ছিল।
আমাদের পরিকল্পনা টা এমন যে, আমার দুই বন্ধু নির্ঝর আর সতীর্থ আগে থেকেই চট্রগ্রাম থাকবে আমরা বাকী তিনজন রাজু, রাহিব আর আমি ট্রেনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়ে ওদেরকে সাথে নিয়ে বান্দরবন এর উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। পরিকল্পনা মতই আমরা রাতের ট্রেনে উঠে পড়লাম। পরদিন সকাল ৮ টার দিকে আমরা চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌছানোর পর বাকী দুজন আমাদের সাথে যোগ দিল । সবাই সকালের নাস্তা করে আমরা নতুন ব্রিজ এর উদ্দেশ্যে সিএনজি তে রওনা দিলাম যেখান থেকে আমরা চকরিয়া পর্যন্ত বাসে যেতে পারবো। চকরিয়া পর্যন্ত আমরা বাসে আসার পর সেখান থেকে নেমে জীপ ভাড়া করলাম এবং সাথে আরো একটা গ্রুপ আমাদের সাথে ক্যাম্পিং এ যাওয়ার জন্য আমাদের সাথে জীপে পথসংগী হলো। ও আরো একটা কথা, জীপের ড্রাইভার বললো সবার কাছে যেন আইডি কার্ড থাকে কারণ আলিকদম ঢোকার পথে সেনাবাহিনী কে সবার পরিচয় পত্রের ফটোকপি দিতে হয়।
সবাই গান, আড্ডা সাথে সবুজ প্রাকৃতি, পাহাড়ের ছোয়া নিতে নিতে চলে এলাম সেনা চেকপোষ্ট এ। পরিচয়পত্র শেষ হওয়ার আরো ৩০ মিনিট পর আমরা চলে আসলাম আলিকদম আবাসিক। সূর্য তখন মাথা বরাবর। এখনো আমাদের পাহাড় ট্র্যাকিংয়ের আসল পথটুকু বাকি। আমরা দুপুরের খাবার পর্ব সেরে নিলাম ওখানের হোটেল থেকেই। আর রাতে ক্যাম্পিং এর জিনিসপত্র, বারবিকিউ এর জন্য উপকরন, জ্বালানি কাঠ, পানি গাইডের মাধ্যমে কিভাবে গুছিয়ে নিয়ে যাবো সেটা গাইডের সাথে আলোচনা করে নিলাম। এরপর একটা ইজিবাইকে সবাই মারায়ংতং এর পাদদেশ এ চলে এলাম। ওখান থেকে এবার আমাদের ১৬৪০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হবে। প্রায় দুই ঘন্টার পাহাড় ট্রাকিং।সবার হাতে দুইটা করে পানির বোতল সাথে সবার ব্যাকপ্যাক কারণ উপরে তেমন কিছুই পাওয়া যাবে না ।
সবকিছু মিলিয়ে আমাদের অবস্থা প্রায় নাজেহাল এর সাথে উপহার স্বরুপ রোদ তো আছেই। পাহাড় ধরে উপরে ওঠার রাস্তা এতোটাই খাড়া যে আমাদের হাতে থাকা বাশের সাপোর্ট টাও ঠিক মতো কাজ করছে না। অল্প পথ যেতেই হাপিয়ে উঠলাম সবাই কিন্তু পাহাড়ের উপরে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে অসীম দিগন্ত দেখার কথা ভাবতেই নতুন উদ্যমে আবার চলা শুরু করলাম। প্রায় ২ ঘন্টা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা বিকাল ৫ঃ৩০ টা নাগাদ মারায়ংতং এর চূড়ায় পৌছালাম।
ঠিক গোধূলি ছুই ছুই মূহুর্তে পশ্চিম আকাশের সৌন্দর্য টা আরো দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে। ওই সময়ের মূহুর্তটা আসলে এই কয়েকটা শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব হবেনা। তবে আমরা নতুন এক সৌন্দর্যের সাক্ষী হতে পেরেছি এটাই আমাদের কাছে অনেক বেশি। আমরা চূড়ায় উঠে রাতে থাকার জন্য তাবুর ব্যবস্থা করে নিলাম ২ টা তাবুর ব্যবস্থা করলাম যেখানে ৩ জন করে থাকতে পারে এক একটাতে। রাত এ ক্যাম্প ফায়ার এর ব্যবস্থা করা হলো আগেই বলেছি শীত তখনও শেষ হয়নি আরো পাহাড়ের চূড়ায় শীতের প্রকোপ কোন অংশে কম নয়। সবাই গান, আড্ডা তে শিশির ভেজা রাতে অনেক মজা করলাম এমনকি আমাদের পাশের তাবু থেকে অন্য জায়গা থেকে আসা কয়েকজন এসে আমাদের আড্ডায় যোগ দিল।
এরপর শুরু করলাম আমাদের বারবিকিউ তৈরির প্রস্তুতি, বারবিকিউ বানাতে গাইড আমাদের সাহায্য করলো প্রায় সবই তিনি করে দিলেন। খেয়ে ঘুমাতে আমাদের প্রায় রাত ২টা। সবাই যে যার মত তাবুতে ঘুমিয়ে পড়লাম রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে। ভোর এর অনুভূতি টা ছিলো অব্যক্ত । চারিপাশ সাদা মেঘে ঢাকা। দূর থেকে যেন ভেসে ভেসে মেঘ আমাদের ভেদ করে চলে যাচ্ছে অন্যদিকে।
সকালের কাঁচা রোদ যখন কুয়াশা ভেদ করে আসতে শুরু করেছে তখন চারপাশটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে শুরু করল। আমরা সবাই ওই সময়ের কিছু মূহুর্ত আমাদের মোবাইল ফ্রেমে বন্দী করি। এরপর সকাল সকাল আমরা পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে আসি কারণ সূর্যের প্রখরতা বাড়তে থাকলে তখন আরো বেশি কষ্টসাধ্য হবে আবার নিচে নামা। আমরা নেমে আবার আলিকদম আবাসিক চলে আসলাম আর সেখান থেকে সকালের নাস্তা টা সেরে নিলাম।
এখন ফেরার পালা ঢাকা ফেরার ট্রেন চট্টগ্রাম থেকে বিকাল ৫ টায়। জীপে আমরা আবার আলিকদম থেকে চকরিয়া এসে চট্টগ্রাম এর বাস ধরলাম যাতে সময়মত ট্রেন ধরতে পারি। আমরা সময়ের আগেই স্টেশনে পৌছে গেলাম। আর ঢাকাতে ফিরলাম রাত ১০ টার মধ্যে।
আমাদের যাত্রা হয়তো ওই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ কিন্তু তার রেশ সারা জীবনে কাটানোর মত না। কিছু স্মৃতি সারাজীবন মনের পাতায় অমোচনীয় কালির মত লেগে থাকে। এই অনূভুতিও ঠিক এমনি এক জাদুকরী অমোচনীয় কালির মত আমাদের মনে এখনো লেগে আছে।