
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ। বাড়ীর বাইরে বের হইনা তেমন বের হলেও কাছের মসজিদ পর্যন্ত যাই। আমাদের বাড়ীর সামনের কপোতাক্ষ নদ কচুরীপানায় ভরে গেছে। ধীরে বয়ে চলছে নদ। কোন নৌকা দেখিনা নদের বুকে। মনে হয় নদের বুকেও শোক। যাদের সাথে দেখা হয় তাদের অনেকের কাছ থেকেই অনেক কথা শুনি, শুনি লুটপাটের খবর, সংখ্যালঘুদের খুঁজে বেড়ানোর খবর। এর সবই ঘটেছিলো যখন ঝিকরগাছা পাক-বাহিনী দখলে নিয়েছিলো এপ্রিল ১৯৭১ এ।
আমাদের বাড়ীর কাছেই একটি ভাঙ্গা দুতলা বাড়ী ছিলো। সেখানে একজন সংখ্যালঘু ভদ্রলোক (কাকা) বাস করতেন। তিনি ধ্যুতি পরে চলা ফেরা করতেন, ব্যবসায়ী। এপ্রিলের ঐ সময়ে তিনি ঐ বাসায় ছিলেন, বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় হয়তো পাননি আর ভয়ে বের হতেও পারেন নি। পাকিস্তান সেনা বাহিনীর সে সময়কার স্থানীয় দোসরদের কানে এ সংবাদ চলে যায়। একদিন সকালে বাড়ীর সামনে দলবল এসে ডাকাডাকি শুরু করলো। লোকটি বাসা ছেড়ে পাশের বাসার ছাদ টপকে পরের বাসার ভেতরের সিড়ির মধ্যে বসে কাপতে লাগলেন। বড় ভাই লুৎফর রহমান খান গ্রাম থেকে নিজের বাসায় এসে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দুতলায় ওঠার সিড়ির মাঝে দেখতে পেলেন কাকা বসে কাপছেন।-বাবা আমাকে বাঁচাও। কাকার হাতে এক বান্ডিল টাকা। ভাই উপরে এসে ডান বায়ে দেখে নিলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে দলবল নিয়ে লুটপাটকারীরা নীচে এসে ভাইকে ডাকছে। ভাই নীচে চলে এলেন। কাকাকে নীচের গেডাউনের ভেতর ধানের বস্তার পেছন লুকিয়ে রেখে এলেন।-ভাই আপনার বাসায় পাশের বাসার লোকটি পালিয়েছে।-আমি কেবলই এলাম, কোথাওতো কাউকে দেখালাম না। -আপনি ঠিক কথা বলছেন না।–আল্লার কিরে আমি কাউক পাইনি বাসার ভিতর। ভাই কিরে কাটলেন। ভাই প্রভাবশালী এবং সাহসী তাইতো এই বিপদের মধ্যে নিজের বাড়ীটি দেখতে এসেছেন। অবশেষে তারা ফিরে গেল। ভর দুপুরে কাকাকে একটি সাইকেলে উঠিয়ে দূরে গ্রামের পথে পাঠিয়ে দিলেন। সাক্ষৎ মৃত্যুর হাত থেকে কাকা রক্ষা পেলেন।
এপ্রিল মাসে পাকসেনারা যখন এলকায় প্রবেশ করে তখন শহরে কাক-পক্ষীও ছিলোনা। পথে তারা একটি গ্রামে ঢোকে এই গ্রামটি ছিলো রেল লাইনের পাশে। একটি বাড়ীতে ঢুকলো তিন সেনা হাতে রাইফেল। ঘরে লুকিয়েছিলো কোলের ছেলেকে নিয়ে আষ্টাদশী মেয়েটি। ছেলেটি মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে দরজা দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। এখানে ধর্ষিত হলো এ গ্রাম্য বধূ অসহায় পিতামাতার সামনে।
৩ দিন পর পাক-বাহিনীর ঐ তিন সেনা আবার এলো গ্রামে, তারা জানতে চাইলো-ছোকরী কাহা? -ছোকরী নেহী হায় । সোলজার আয়াতো ছোকরীকো উঠা লে গিয়া। গ্রামবাসী ধর্ষিতা বধূকে আগেই সরিয়ে ফেলেছিলো আসন্ন আরো বিপদ থেকে।
ইনুভিক, কানাডা