11.6 C
Toronto
রবিবার, মার্চ ১৬, ২০২৫

বাংলা নববর্ষ নিয়ে কিছু কথা

বাংলা নববর্ষ নিয়ে কিছু কথা
বাংলা নববর্ষ এলেই কিছু বিতর্ক যুগযুগ ধরে উসকে দেয়া হয় বলে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে

বাংলা নববর্ষ পালন নিয়ে কারো কোন বিভেদ আছে বলে জানা নেই। বাংলাদেশের মানুষ যে কোন উৎসব পালন করতে অন্য জাতির চেয়ে একটু বেশীই মুখিয়ে থাকেন বলে মনে হয়। বারো মাসে তের পার্বন বলে একটা কথা আছে। তবুও বাংলা নববর্ষ এলেই কিছু বিতর্ক যুগযুগ ধরে উসকে দেয়া হয় বলে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে। কি সেই বিতর্ক এবং বিতর্কের কারণ ও সমাধান নিয়ে কিছু আলোচনা হওয়া উচিত বলে আমার মনে হলো। মোটা দাগে এই বিতর্ক শুরু হয় বাংলাদেশের প্রধান দুটো সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে। যতদুর জানা যায় বাদশাহ আকবরের আমল থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয় বা নববর্ষ পালন শুরু হয়। হালখাতা, নবান্ন, পান্তা খাওয়া, বাংলার কৃষ্টি সংস্কৃতি তুলে ধরা, একে অপরকে উইশ করা, মংগল কামনা করা ইত্যাদি নববর্ষ পালনের অংশ এবং তা নিয়ে কোন বিতর্ক কখনো ছিল বলে মনে পড়ে না। বিতর্ক শুরু হয়েছে আশির দশকের শেষ দিকে আনন্দ শোভাযাত্রাকে ১৮০ ডিগী ঘুরিয়ে মংগল শোভাযাত্রা নামকরণ করে শোভাযাত্রার মুল অর্থকে ঘুরিয়ে দেবার মাধ্যমে। শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন ইচ্ছাকৃত ছিল নাকি যুগের চাহিদা ছিল সে বিতর্কে আমি যাব না। আনন্দ শোভাযাত্রায় বাংলাদেশের সকল ধর্ম বর্ণের লোকেরাই অংশ নিত বলে আমার মনে পড়ে। আমি নিজেও দু একবার সেই শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছি। মনে পড়ে প্রচন্ড গরমে শাহবাগ থেকে হেঁটে হাজার হাজার লোকের সাথে টিএসসি পর্যন্ত গিয়েছি, রমনা পার্কে গিয়েছি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর দিয়ে হেঁটেছি। রমনায় পান্তা খেতে আমার আপত্তি ছিল, কারণ দুটো। মুল কারণ ছিল ধুলোবালি। অপরটি ছিল, বড়লোকদের শখ করে পান্তা খাওয়া অপছন্দ করতাম। কারণ ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আমাদের শহরে বিদ্যুত ছিল না, তখন রাতের খাবার শেষে অবশিষ্ট ভাতে পানি দিয়ে রাখতে হতো। সকালে সেই পান্তা সাধারণত বাড়ীর কাজের লোকজনকে নিয়মিত খেতে দেখেছি। কখনো কখনো আমরা নিজেরাও খেয়েছি সামান্য চর্চরি বা ইলিশ মাছের ঝোল মিশিয়ে বেশ মজা লাগতো বলে।

যাহোক, তাহলে বিরোধটা কোথায় এবং কেন এই বিতর্ক? বাংলাদেশে মোটাদাগে দুটো সম্প্রদায় হিন্দু এবং মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে সুকৌশলে বাঙালী সংস্কৃতির বিরোধ ঢুকিয়ে দেয়ার পর থেকেই এই বিরোধ শুরু হয় বলে আমার ধারনা।

- Advertisement -

নববর্ষ পালন বা মংগল শোভাযাত্রা নিয়ে বিরোধ? নাকি মংগল শব্দ নিয়ে সমস্যা? মোটেই না। মংগল মানে কল্যাণ। তাহলে কি শোভাযাত্রা বা শোভা শব্দ নিয়ে বিরোধ? অবশ্যই না। এগুলো যারা বলেন, তারা ইচ্ছাকৃত এসব বলে বাংলাদেশের মানুষকে একটা বিভেদের মধ্যে রাখতে চান। এই বিভেদ তৈরী করার বিষয়টা মুলত সাংস্কৃতিক বিরোধ নয়, আমি মনে করি এটা রাজনৈতিক। কারণ যে শ্রেণীটা এই বিরোধ তৈরী করেন, জিইয়ে রাখেন, তারা মুলত ডিভাইড এন্ড রুল নীতিতে বিশ্বাসী। এই নীতিতে তারা বেশ সফলও হয়েছেন তবে সেই বক্তব্যে আমি এখন যাব না।
উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমান বিরোধ কাজে লাগিয়ে ভারতে এবং বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবৎ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা হচ্ছে তা সকলেই জানেন। তবে নববর্ষ পালনে বিরোধটা কি?

মুল বিরোধটা হলো ধর্মের ভিত্তি। দুটো ধর্ম বিশ্বাসের মুল জায়গা বিপরীতমুখী। মুসলমানেরা সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদে বিশ্বাস করেন। কাউকে মুসলমান হতে হলে সর্বপ্রথম ঈমান আনতে হবে। ঈমান অর্থ বিশ্বাস। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং তার নবীর প্রতি বিশ্বাস আনতে হবে। কেউ মুসলমান হলে তাকে কলেমা পড়তে হবে। প্রথম কলেমাটা হলো, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সা:) আল্লাহর প্রেরিত রাসুল। মুসলমানদেরকে বলা হয়েছে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কাউকে সেজদা করা যাবে না বা অন্য কারো কাছে মাথা নত করা যাবে না। পৃথিবীর মানুষের মংগল করতে পারেন একমাত্র আল্লাহ। কারণ তিনি পরাক্রমশালী, সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বশক্তিমান। অন্য কেউ যেমন কোন সুর্য, চন্দ্র, দিন রাত, জন্তু জানোয়ার মানুষের মংগল করতে পারে না। আর একটি বিষয় হলো, আল্লাহ নিরাকার। তার কোন আকার নাই। তার কোন শরীক নাই। তার কোন আত্মীয় নাই। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি দেখতে কেমন তা কেউ জানে না। অর্থাৎ মুল কথা হলো, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা যাবে না এবং তার একত্ববাদে বিশ্বাস করতে হবে। এটাই মুল কথা। এখন কোন জাতির লোক তিনি বাঙালী হন বা ইংরেজ হন, যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন, এই মুল জায়গায় বিশ্বাস না করলে তিনি মুসলমান হতে পারবেন না।
একজন মুসলমান অনেক কিছুর সাথে আপোষ করেন কিন্তু এই জায়গাটায় আপোষ করতে পারেন না। করলে তিনি আর মুসলমান থাকেন না।

বাংলাদেশের নববর্ষের আনন্দ শোভাযাত্রা পরিবর্তন করে যখন থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হলো এবং সেই শোভাযাত্রায় যে সব ছবি এবং প্লাকার্ড বহন করে উইশ করা হলো, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে আমি এই নুতন বছরের প্রথম দিনে নিরাকার, সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে নয়, সুর্যের কাছে, বা শক্তিশালী কোন জন্তু বা প্রাণীর কাছে মংগল কামনা করছি। যেগুলো কোন কোন বাঙালী তার নিজ ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী করতেই পারেন। আবার কেউ কেউ নাও করতে পারেন।

তাহলে এটা পরিস্কার হলো, বাঙালীর নববর্ষ পালন নিয়ে কিংবা মংগল শোভাযাত্রা নিয়ে কোন বিরোধ নেই। বিরোধটা হলো শোভাযাত্রাকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাখা নিয়ে। আনন্দ শোভাযাত্রা যখন মংগল শোভাযাত্রা নামকরণ হলো তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু কোন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী বাঙালী যদি ‘হে আল্লাহ, নববর্ষে বাঙালী জাতিকে নিরাপদে রাখুন’, ‘হে আল্লাহ, আমাদেরকে মংগল করুন’ ইত্যাদি প্লাকার্ড বহন করে শোভাযাত্রা করেন, তাকে কি এলাও করা হবে? অথবা কেউ যদি আলাদা মংগল শোভাযাত্রা বের করে নুতন বছরে মানুষের বিপদ আপদ দুর করার দোয়া কলেমা সম্বলিত প্লাকার্ড বহন করে, ফল ফলাদি, ফসল ফলনে বরকতের জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা সম্বলিত প্লাকার্ড বহন করে তাহলে তা কি সহজভাবে মেনে নেয়া হবে?

আমরা যত কথাই বলি না কেন, আমাদেরকে বুঝতে হবে আমরা আসলে কি চাই? আমরা কি শান্তি চাই নাকি অশান্তি চাই? নববর্ষে এই যে নানা ধরনের উইশ করা হয়, মুছে যাক গ্লানি, জরা, খরা দুর হোক বলি, এগুলো সবই যদি মনে প্রাণে চাই তাহলে সবার আগে সকলের শান্তি বজায় রাখার প্রচেষ্টা করতে হবে। আগেই বলেছি, বাংলাদেশের সমাজে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, আস্তিক, নাস্তিক সকলেরই অস্তিত্ব আছে। কেউ কাউকে হেয় করে, খতম করে, গালি দিয়ে বহু ধর্ম, বহুমতের সমাজে শান্তি বজায় রাখা সম্ভব নয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্ম একটি সেনসেটিভ বিষয় এবং এর শেকড় অত্যন্ত গভীরে। যে কারণে ধর্ম ব্যবসায়ীরা ভারত এবং বাংলাদেশে ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা নেবার চেষ্টা করে। তাতে যদি হাজার মানুষের প্রাণ সংহার করতে হয় তাতেও তারা পিছু হটেন না, এটাই ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস। আবার এর উল্টো ইতিহাসও আছে। মানুষ মানুষের জন্যে, মানুষের পাশে দাড়ানোর জন্যে, মানুষকে রক্ষা করার জন্যে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের জন্যে প্রাণ বিলিয়ে দেয়ার ইতিহাসও এই উপমহাদেশে আছে। মোট কথা হলো, বর্তমান বিশ্বে দুটো ধারা চলছে, একটা হলো উগ্রোবাদী ধারা যারা ভিন্নমতালম্বী, ভিন্ন ধর্মের মানুষদেরকে নিশ্চিহ্ন করে রক্তের হোলিখেলা খেলতে চায়, অপর ধারাটি হলো, সবাইকে নিয়ে সুখে শান্তিতে দেশ গড়তে চায়, যেটাকে বলা হয় ইনক্লুসিভ ধারা। সবাইকে নিয়ে দেশ ও দেশের মানুষকে শান্তিতে বসবাস করতে চাইলে অবশ্যই আমাদের এই বাঙালীর নববর্ষ, মংগল শোভাযাত্রাকেও হয় ধর্ম নিরপেক্ষ রাখতে হবে অথবা সবার ধর্মের প্রতিফলন বা চাওয়া সেই শোভাযাত্রায় থাকতে হবে। সেটার নাম মংগল শোভাযাত্রাই হোক বা আনন্দ শোভাযাত্রাই হোক। নীচের ছবিটি আজ থেকে ৩৪ বছর আগের যখন পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা বের করা হতো। আসুন সবাই সহাবস্হান বজায় রাখি। আমি বিশ্বাস করি বাঙালী সংস্কৃতির সাথে কোন ধর্মের বিরোধ নেই। আমি যেমন বাঙালী তেমনী আমি মুসলমানও বটে। আপনি যেমন বাঙালী তেমনী আপনি হতে পারেন হিন্দু বৌদ্ধ বা খৃষ্টান। আপনি যদি বাঙালী হয়েও আপনার ধর্ম পালন করলে, ধর্মীয় নিয়ম নীতিসুমহকে সমুন্নত রাখতে চাইলে আপনাকে আমি সাম্প্রদায়িক পিশাচ বলতে পারি না, তেমনী আপনিও অন্য বাঙালীকে তার ধর্মীয় নিয়ম নীতির জন্যে গালি দিতে পারেন না। আমরা মানি আর না মানি সবাই আমরা বাংলাদেশের বাঙালী বা মারমা, চাকমা ইত্যাদি।আপনার যেমন ইচ্ছে আনন্দ করুন কিন্তু অন্যকে জোর জবরদস্তি করতে পারেন না। তবে মনে রাখা দরকার ভিন্ন মত সত্তেও, ভিন্ন ধর্মের বা বর্ণের হওয়া সত্তেও আমরা এক সমাজে শান্তিতে বসবাস করতে পারি, একসাথে কমন গ্রাউন্ডের ভিত্তিতে উৎসব পালন করতে পারি যদি আমাদের থাকে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা। সবাইকে শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩০।

স্কারবোরো, কানাডা।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles