
আমাদের দেশের কিছু সিদ্ধান্ত অতুলনীয়।
যেমন, কাঁঠালকে বাংলাদেশের জাতীয় ফল বানানো। এর চাইতে ওয়াইজ ডিসিশন জীবনে দেখিনি, ভবিষ্যতে দেখার সম্ভাবনাও কম। গিফটের জন্যও সেরা। মানুষকে পাকা কাঁঠাল দিলে বেজায় খুশি, কচি কাঁঠাল দিলে আরও বেশি খুশি। পাকা কচকচে কাঁঠাল পেলে বলে- ওমা, কি কচকচে গো! আবার টসটসে ল্যাংরা আমের মতো হলে বলবে- সুন্দরবনের মধুর মতো গো..
.
এর কোন অংশটা খাওয়া যায় না? খোসা থেকে শুরু করে বিচি। বাইরের আবরণ, মুতা, পাতা গৃহপালিত পশু গোগ্রাসে খায়। ঘন্ট, ভাজি, চপ, ভুনা; সব কিছুই অনন্য। এর একটাই দোষ ফ্রীজে রাখলে ভেতরের সবকিছুকে আপন মনে করে কাঁঠাল বানিয়ে ফেলে। আমরা ছোটকালে কাঁঠালের ভেতর যে ফিতার মত যে মিষ্টি জিনিসগুলো পাওয়া য়ায়, সেগুলো খুঁজে খুজে বের করে খেতাম। ওগুলোকে বলতাম চাপ। আরও বেশি মজা।
.
কাঁচা কাঁঠাল ঘন্ট জিনিসটার ওপর বাংলার মানুষের অসীম দুর্বলতা। পাঁচফোড়ন, কাঁচামরিচ দিয়ে ঘন্ট করলে ঘন পায়েশের মতো যে জিনিসটা পাওয়া যায়, সেটার মতো ইউনিক জিনিস মনে হয় না দুনিয়ায় আর কেউ আবিষ্কার করেছে। এর আবিষ্কারক নানির/দাদিকে পেলে উনার পায়ের ধুলা আমার টাকমাথায় মেখে মাসখানেক গোসলই করতাম না। এর কাছে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারও নস্যি। আচ্ছা, আমেরিকাতে স্থানীয় আদিবাসীরা হাজার বছর ধরে ছিল না? তাহলে এটাকে আবিষ্কার বলার মানে কী?
আজাইরা…
.
কালোজিরাগুলো হলদে-সাদা কাঁঠালে যে অপূর্ব শোভা তৈরী করে, মনে হয় যেন রাতের পরিষ্কার আকাশের বুকে অসংখ্য তারার মেলা ঝিকমিক করছে। ঘন চোরাবালির মতো জিনিসটা ঠেলে পাঁচফোড়নের গন্ধ কীভাবে বের হয়ে বাতাসে মিশে?
সৃষ্টিকর্তার কি অসীম কেরামতি!
.
আর কাঁচা কাঁঠালের ফালি দিয়ে চিংড়ি মাছের ভুনা? ভাই রে ভাই… এটার সাথে অন্য কিছুর তুলনা চলে? কোনটা রেখে কোনটার গুনগান গাইবো? ঘন মাসকালাই ডালের মধ্যে কাঁঠাল ঘন্ট, কাঁঠাল চিংড়ি আর আমড়ার টক নিয়ে যখন ইরিধানের ভাতের নলা মুখে তুলবেন, মনে হবে আপনার হাতের মুঠির সাইজটা আসলে পর্যাপ্ত নয়। তালপাতা পাখা সাইজের, ওরাং ওটানের মতো হাতের তালু হলে কত জমতো?
.
আর বিচির কথা বলতে গেলে মহাভারত লেখা শুরু করতে হবে। কি নিরামিশ, কি তরকারি। কিম্বা গরু-মুরগির সাথে। এর ভর্তা হলো দুনিয়ার এক নাম্বার। ভাজা পেঁয়াজের সাথে কাঁঠালের বিচির একাত্মতায় পোড়া বারবিকিউয়ের মতো বাসনা যখন নাকে এসে বিঁধে, আর চিবানোর সময় ভাঙা বিচি যখন দাঁতের তলায় ডাল সমেত পিষণের সময় লালার সাথে ভিজে ; আপনি নাস্তিক হলে নিশ্চিত আস্তিকতার দিকে ধাবিত হতে বাধ্য। বাংলাদেশকে সৃষ্টিকর্তা তার অকৃপণ দুহাতে স্বাদ ঢেলে দিয়েছেন। তবুও কেন মানুষের এতো চাহিদা, এতো লোভ-লালসা; কেন অন্যের ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে খায়?
.
.
কাঁঠালভুনার চিংড়িগুলো হলো একেকটা মনি মুক্তো। থালের পর থাল আলগোসে চালান হয়ে যায়। ভাত খাওয়াতো নয়, যেন জগ থেকে বোরহানি সরাসরি গলায় ঢালা। আগে বহুবার বলেছি- বিজ্ঞানীরা শুধু জিব্বার টেস্ট বাডগুলোই খুঁজে পেয়েছে, কিন্তু গলার মধ্যেও যে ওগুলো ঘাপটি মেরে বসে আছে তীর্থের কাকের মতো, সেটার সন্ধান এখনো পায়নি। তা না হলে লবন ছিটানো ভাতের মাড় গলায় ঢালতে এতো মধুর লাগে কেন? আমড়ার টকের সাথে ডালে সিক্ত কাঁঠাল চিংড়ি আপনাকে এক অলীক জগতে নিয়ে যাবে। যে জগৎ সারা বিশ্ব থেকে আলাদা, মাত্র পঞ্চান্ন হাজার পাঁচশো আটানব্বই বর্গমাইল সার্কেলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
.
কারেন্টবিহীন, চল্লিশ ডিগ্রী গরমে ঘেমে গোসল হয়েও এ তরকারি দিয়ে ভাত খেতে কারো কোনো অভিযোগ নেই।বাঙালি সহনশীল জাত। আমি বাজি ধরতে রাজি, এ খাবার খেয়ে আপনাকে এক মিনিটের মধ্যে মাতালের মতো টলতে টলতে বিছানায় কিংবা মুছে রাখা ঠান্ডা মেঝেতে শুতেই হবে। তারপর দুই মিনিটের মাথায় আপনি যদি ঘুমে তলিয়ে না যান, আমার নামই মিছে! শুরু হবে এক পাকাপোক্ত কাঁঠাল ঘুম। দু-ঘন্টার আগে কোনো নড়নচরণ নাই, গায়ের উপর দিয়ে কেউকেটা চলে গেলেও টের পাবেন না। গন্ডার এসে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলেও আপনাকে এক চুল জাগাতে পারবে না!
.
কাঁঠালের ঘন্ট খেতে হয় লাল টকটকে গরম লাভার মতো অবস্থায়। সাথে থাকবে আগুন গরম ডাল, পাকা টমেটো আর নতুন আলুর চিকন ফালি দিয়ে ধোনে পাতা ছিটানো নলা মাছের ঝোল। এ আহার শেষ করতেই মন চায় না.. ইচ্ছে হয় যেন অনন্ত নক্ষত্রবিথীতে স্পেসশিপে করে শুধু চলতেই থাকি চলতেই থাকি..। আহারে..
গরমকালে, মধুমাসে দেশে গিয়ে শুধু একটিবার, শুধু একটিবার এ খাবার খাওয়ার সুযোগ দাও খোদা..
.
“এই ভাত যদি না শেষ হয়,
তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?
যদি পৃথিবীটা ঘন্টের দেশ হয়, তবে
কেমন হতো তুমি বলোতো?”
তুমিই বলো?
– না তুমি বলো..
– ধ্যাৎ তুমি বলো..
অটোয়া, কানাডা