
বিষয়টি এরকম নয় যে হঠাৎ করে পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করে ৯৫ হাজার সেনা পাঠিয়ে বাংলাদেশ দখল করতে গেল আর কিছু লোক বিদ্রোহ করে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে ফেললো। মুক্তিযুদ্ধ শুধু নয় মাসের মাঠের যুদ্ধে হয় নাই। মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলতে কাজ শুরু হয়েছিল অনেক আগে। বক্তৃতার মঞ্চে স্বাধীনতার আকাংখা ব্যক্ত করে স্বপ্ন দেখার লোক হয়তো অনেকেই ছিলেন কিন্তু স্বাধীনতা অর্জন করতে একটি মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন হবে এবং সেই যুদ্ধকে সংগঠিত করতে ৬২ সাল থেকে কাজ শুরু করেন সিরাজুল আলম খান। ৬২-৭০ যুদ্ধ পুর্ব সময়ে এবং ৭১ এর নয় মাস সরাসরি মাঠে থেকে, ক্যাম্পে থেকে, ট্রেনিং নিয়ে, ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী বাংলাদেশ কিভাবে পরিচালিত হবে, তার পতাকা কেমন হবে, জাতীয় শ্লোগান কি হবে, তার সরকার কেমন হবে, চেহারা কেমন হবে এসবই যিনি ভেবেছেন একটি আদর্শ ও নীতিকে সামনে রেখে তাদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
ইতিহাস অনেকেই জানেন। আমি সে সব বিষয়ে যেতে চাই না। বাঁশের লাঠিকে রাইফেলের মত করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রেনিং শুরু হয়েছিল। লাল সবুজ পতাকার মধ্যে হলুদ রঙের বাংলাদেশ ভুখন্ড দিয়ে সেই পতাকা উড়ানো শুরু হয়েছিল, এসব কিছুর নেতৃত্ব যারা দিয়েছেন সে সময় তারা অধিকাংশই ছিল ছাত্র যুবক। অনেক মুরুব্বী বয়স্ক লোকজনকে বলতে শুনেছি, এই ছাত্ররাই দেশটাকে শেষ করে দিল! না, ছাত্ররা দেশটাকে শেষ করে দেয় নি, তারা আমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। তখন তারা ছিলেন এ্যাডভান্স থিংকার। সেই থিংক ট্যাংকের প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
ইতিহাস নিয়ে যাঁদের আগ্রহ আছে তারা জানবেন সিরাজুল আলম খান যখন স্বাধীনতার লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে নিউক্লিয়াস গঠন করেন, তিনি যখন ছাত্রলীগের সহকারী সাধারন সম্পাদক, তারপর ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক ও পুর্ণ সাধারণ সম্পাদক হন তখন তাঁর বয়স কত ছিল? মুলত মানুষের সর্বোচ্চ ক্রিয়েটিভিটি থাকে ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এই বয়সের স্বপ্নবাজ তরুণ যুবকেরা তখন জীবনের পরোয়া করে না, যে কোন কিছু জয় করবার, অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা ধারণ করে তারা। সিরাজুল আলম খাঁনের বয়সও তখন ছিল ২০/২১।
১৯৯১ সালে বিশ্বে কমিউনিজমের ধ্বস নামে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেংগে পড়ার মাধ্যমে। চীন, রাশিয়া সবই এখন পুঁজির পেছনে ছুটছে। কাজেই সিরাজুল আলম খাঁনের “আমরা লড়ছি সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে” শ্লোগান শুধু নয় অন্য অনেক সমাজতন্ত্রীদের আদর্শ নীতিও বাস্তবায়িত হতে পারে নি, ভেংগে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে বিগত পাঁচ দশকে। সিপিবি ভেংগেছে, সর্বহারা পার্টি বিলীন হয়েছে, ন্যাপ, ওয়ার্কাস পার্টি কোন রকমে টিকে আছে!
কাজেই আজকের তরুণ যুবক যারা বিগত দুই দশকের শাসন ব্যবস্হা দেখেছেন, যারা না জেনে সমালোচনা করছেন তারা তাদের তরুণ যুবক বয়সে কি করেছেন, দেশ ও জাতিকে কি স্বপ্ন দেখাতে পেরেছেন, সেটা নিয়ে একবার ভেবে দেখতে পারেন। স্বাধীনতার আগে এবং পরের ঘটনাবলী এবং সেই সময়ের রাজনীতি ও নেতৃত্বের সমালোচনা করতে হলে সই সময়ে আপনাকে ফিরে যেতে হবে। সোস্যাল মিডিয়া ছিল না, মোবাইল ছিল না, পা’য়ে হেঁটে, খেয়ে না খেয়ে যারা পোষ্টার লাগিয়েছেন, দেয়ালে চিকা মেরেছেন, স্বৈরতন্ত্রের বুটের লাথি খেয়েছেন, বছরের পর বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তারুণ্যকে যৌবনকে বিসর্জন দিয়েছেন তাদের আত্মত্যাগ আপনি উপলদ্ধি না করতে পারলেও যাঁদের আত্মত্যাগে এনে দেয়া স্বাধীন দেশটাকে উপভোগ করতে পারছেন এর জন্যে আমাদের উচিত অন্ততঃ মরণকালে কাল্পনিক সমালোচনার কন্টক না বিছিয়ে যেন একটি ফুল তাদের কফিনে দিতে পারেন সে চেষ্টা করা।
স্কারবোরো, কানাডা