
তীব্র ঝড়ের মধ্যে গাড়ির ভেতর ঘাপটি মেরে বসে আছি। অফিসের ফিল্ড ওয়ার্ক মাথায় উঠলো। ছোটোখাটো শিল পড়াও শুরু হয়ে গেলো। ঝমঝম বৃষ্টিতে সব ভেসে যাচ্ছে। এরকম বৃষ্টি মানেই মনটা খুশিতে ভরে ওঠা।
.
ঠিক এ সময় বিত্ত’র ফোন আসলো। সে সাধারনত কাউকে ফোন করে না। তবে রিসিভ করতেই দখিনা’র গলা ভেসে উঠলো- আব্বু!
– কি খবর বল
– ঝড় হচ্ছে!
– হু.. ভয় পাচ্ছিস?
– না
– আসলে পাচ্ছিস.. হি হি!
– তোমাকে খুব মিস করতেছি আব্বু
– আমিও।
.
পাশ থেকে বিত্ত বলে উঠলো- আব্বু, এরকম বৃষ্টিতে তোমার সাথে ভিজার কথা ছিল যে?
– নেক্সট টাইম তোকে নিয়ে ভিজবো
– আর আমি? (সাথে সাথে দখিনার অভিমানী অভিযোগ)
– তোকে তো নিবোই রে বোকা!
– আব্বু..
– আমাকে লাভ করিস কেন?
– আরি! তুমি কীভাবে বুঝলা আমি এটাই বলবো?
– জানি।
.
আমি বাইরে থাকলে এরা বৃষ্টির সময় খুব মিস করে।
সামান্য ঝড় হলেও দখিনা একদম দুই বছরের বাচ্চার মতো গুটিশুটি মেরে আমার কোলের মধ্যে গোমড়া মুখে শুয়ে নখ কামড়িয়ে কি জানি ভাবতে থাকে। ভীত হরিণ শাবকের মতো এদিক ওদিক তাকায়। এদের কাছে ঝড় আতংকের ব্যাপার। এদেশের গাছগুলো অল্পতে উপড়িয়ে যায়, ভেঙে পড়ে। সামান্য ঝাপটা বাতাসের বৃষ্টি শুরু হলেই মোবাইলে বিকট, বিশ্রী শব্দে এনভায়রনমেন্ট কানাডার সতর্ক সংকেত বাজতে থাকে। স্ক্রিনে লেখা উঠে- তোমার মোবাইল কভারেজ এলাকায় মারাত্মক ঝড় হবার সম্ভাবনা। খুব সাবধানে বাইরে ঘোরাঘুরি করবা। নিরাপদ আশ্রয়ে থাকবা.. ইত্যাদি ইত্যাদি..
.
আচ্ছা, কানাডিয়ানদের যদি বাংলাদেশের কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে ফেলে দেয়া যায়, তখন কী অবস্থাটা দাঁড়াবে?
.
.
কিছুক্ষণ পর গিন্নি’র ফোন, চাঁদু!
– হু
– কিছু না এমনি। ঝড় হচ্ছে
– তাইতো
– সবার সাথে কথা বললা, আমার সাথে তো বললা না!
– সরি!
– দুপুরে কী রান্না করবো?
– আজকে লেইট হয়ে গেছে, দরকার নাই। ঝড়টা আরেকটু আসলে হতো..
– না, বলো..
– খিচুড়ি?
– আমি জানতাম এটাই বলবা। আর গরু?
– ইয়েস, আলু দিও!
– সময় লাগবে না, প্রেশার কুকারে চড়িয়ে দিচ্ছি..।
আমাদের অটোয়ার ছোট্ট বাসাটার সিঁড়িঘরের উপরের ছাদে এক চিলতে ছোট্ট কাঁচের ছাদ আছে। বৃষ্টি শুরু হলে সেখানে টুপটাপ আওয়াজ হয়। দরজা জানালা বন্ধ থাকলে সাধারনত বাইরের আওয়াজ তেমন পাওয়া যায় না। তবে বৃষ্টি শুরু হলেই আমরা টের পেয়ে যাই; আমরা দৌড়ে সিঁড়ির ওখানে গিয়ে উপরে তাকিয়ে কান পাতি। বাংলাদেশের টিনের চালের মতো মধুর শব্দ না হলেও কাছাকাছি।
কানাডার মানুষ বৃষ্টি খুব অপছন্দ করে। এদের কাছে বৃষ্টি মানেই একটা নোংরা দিন; কর্দমাক্ত পরিবেশ। বিশ্রী একটা ব্যাপার। আমি যখনই কলিগদের বলি- দেখো কি সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে! তখন তারা এমনভাবে তাকায় যেন পাগলের প্রলাপ শুনছে।
অটোয়াতে এ বছর খুব বৃষ্টি হচ্ছে। আজ বেশ কয়েকঘন্টা একনাগাড়ে হয়ে কিছু এলাকায় বন্যা বইয়ে দিলো। এদেশের বৃষ্টির চিত্র বাংলাদেশের থেকে অনেকটাই আলাদা। দেশে বাড়ির জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখবো; কাঁঠাল, আম, সজনে গাছের ডালে অদ্ভুত টাপুরটুপুর শব্দে ভরে উঠবে! গাছের ডালে নির্লিপ্তভাবে বসে কিছু শালিক ভিজবে। ঘন্টার পর ঘন্টা সবুজ গাছের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়। আর কত শত চিন্তা মনের মধ্যে ভর করে! এক কাপ চা হাতে চিন্ময়ের রবীন্দ্রসংগীত শুনতাম নেশার মতো-
“দূরের বন্ধু সুরের দূতীরে পাঠালো তোমার ঘরে।
মিলনবীনা যে হৃদয়ের মাঝে বাজে তব অগোচরে।
মনের কথাটি গোপনে গোপনে বাতাসে বাতাসে ভেসে আসে মনে, বনে উপবনে, বকুল শাখার চঞ্চলতায় মর্মরে মর্মরে।”
অফিস শেষে গাড়ির জানালা সামান্য খুলে দিয়ে হালকা পানির ঝাপ্টা মেখে ছুটে চলি বাসার দিকে। পৌঁছানো মাত্র সবাই ডাইনিং টেবিলে বসার প্রস্তুতি নেবে। দখিনা গরু কে ডাকবে গুরু। বিত্ত ভাত খাবার বিপক্ষে থাকলেও খিচুড়িতে তার না নেই। গিন্নি হয়তো কোনো বিশেষ মশলার কমবেশি নিয়ে কিঞ্চিৎ চিন্তিত থাকবে।
আমার মনটা পড়ে থাকবে বাড়ির লাগোয়া সজনে গাছটার দিকে। ছাদের বৃষ্টিস্নাত জ্বলজ্বলে নয়নতারা, মায়াবী কামিনী গাছটার সৌরভের নেশায়।
কি অপরূপ মাটির, ধুলোর গন্ধ!
অটোয়া, কানাডা