5.2 C
Toronto
রবিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৫

জুটমিল সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি পাটচাষিরা

জুটমিল সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি পাটচাষিরা - the Bengali Times

রাজশাহীর দুর্গাপুর হাটে পাট বিক্রি করতে এসেছিলেন সাহিবাড়ি গ্রামের কৃষক আলম হোসেন। তিনি দেড় বিঘা জমিতে পাটের চাষ করেছেন। এর মধ্যে এক বিঘা জমির পাট বিক্রি করেছেন ২ হাজার ১০০ টাকা মণ দরে। আলম হোসেন জানালেন, তিনি কাক্সিক্ষত দাম পাননি। কারণ এবার পাট উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। এমনকি পাট জাগ দিতে হয়েছে পুকুর ভাড়া করে। ফলে যে দামে বিক্রি করেছেন, তাতে বড় লোকসান হয়েছে। তিনি বলেন, পাটের দাম ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা মণ হলে কৃষকের লোকসান হবে না। কারণ গত বছরের চেয়ে এ বছর প্রতি মণে ১০০০-১২০০ টাকা কম দাম পাচ্ছেন কৃষক।

- Advertisement -

জানা গেছে, বিশ্ববাজারে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এবার পাট রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে। তাই স্থানীয় পাটকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দামি কমিয়ে পাট কিনছেন। ফলে কৃষকরা দাম কম পাচ্ছেন। দুর্গাপুর উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, চাষিদের মধ্যে অনেকের জমিতে এখনো পাট রয়েছে। অনেকেই পাট কেটে জাগ দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার বিক্রিও করছেন হাটেবাজারে। তবে বেশির ভাগ উপজেলায় বর্তমানে পাট কাটা, জাগ দেওয়া, আঁশ ছাড়ানো এবং শুকানো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। তারা জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর একই সময়ে প্রতি মণে ১০০০-১২০০ টাকা কম দামে কেনাবেচা হচ্ছে পাট। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। উৎপাদন খরচের তুলনায় পাট বিক্রি করে কৃষকের লাভ হচ্ছে না। সিন্ডিকেট করে পাটের দাম কমিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবারের পাটের গুণগত মান ভালো নয়। আর বিদেশে চাহিদা কম। তাই পাটের বাজার ভালো নয়।

প্রতিদিনই রাজশাহীর কোনো না কোনো উপজেলায় পাটের হাট বসে। উপজেলা পর্যায়ের এসব হাটে কৃষকরা সরাসরি পাট বিক্রি করতে পারেন। এসব পাট কৃষকদের থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা কিনে থাকেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পাট কিনে সরাসরি পাটকল মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। আর কোনো কোনো আড়তদার পাটগুলো গুদামজাত করে রাখেন। এরপর ব্যবসায়ীদের কাছে সময়মতো তারা পাটগুলো বিক্রি করে থাকেন। পাটের হাট বসে ভোর ৫টা থেকে। চলে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত।

জেলার পুঠিয়ার তাহেরপুরে পাটের হাট বসে সপ্তাহের শুক্রবার। সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার পুঠিয়ার বানেশ্বর হাটে পাট কেনাবেচা হয়। আর রবিবার ও বুধবার দুর্গাপুর উপজেলায় পাটের হাট বসে। বৃহস্পতিবার পবা উপজেলার নওহাটা ও পুঠিয়ার ঝলমলিয়ায় হাট বসে। যদিও এই দিনগুলো সাপ্তাহিক হাটবার।

পুঠিয়ার বানেশ্বর এলাকার কৃষক বেলাল হোসেন এক বিঘা জমিতে পাটের চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘পাটচাষে যে পরিশ্রম করি সেই টাকা পাই না। গত বছরের চেয়ে এ বছর পাটের দাম প্রতি মণে এক হাজার টাকা কম পাচ্ছি। পানি সংকটের কারণে এ বছর পাট জাগ দেওয়া নিয়ে কৃষকের অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। এলাকাভেদে এক বিঘা জমির পাট জাগ দিতে আমাদের একেকজন কৃষকের খরচ হয়েছে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, পাট শুকানো, বাঁধাই করা, গাড়িতে করে হাটে নিয়ে আসা পর্যন্ত আমাদের অনেক খরচ হয়।

পবা উপজেলার নাজমুল হোসেন বলেন, এ বছর কোনো কৃষক নিজের ইচ্ছোমতো সহজ জায়গায় পাট জাগ দিতে পারেনি। কারণ পানির অভাব। অনেকেই পাট জাগ দিতে পুকুর ভাড়া নিয়েছে। এক মণ পাট তৈরি করতে দুই হাজার টাকার ওপরে খরচই পড়েছে। কিন্তু হাটে এসে কৃষককে সেই পাট বিক্রি করতে হচ্ছে দুই হাজার টাকা মণ দরে।

বাঘা উপজেলার হামিদকুড়ার পাটচাষি হাবিবুর রহমান বলেন, তার দুই বিঘা জমির পাট জাগ দিয়েছেন ভাড়া করা পুকুরে। পুকুরটি জোতরঘু এলাকার বেলাল হোসেনের। তিনি পাট জাগ দিতে পুকুর ভাড়া দেওয়ার লক্ষ্যে শ্যালোমেশিন দিয়ে পানি জমিয়েছেন। তার পুকুরে অনেকেই পাট জাগ দিয়েছেন। হাবিবুর রহমানের দুই বিঘা জমির পাট জাগ দেওয়ার জন্য তাকে দিতে হয়েছে ৪ হাজার টাকা।

জুটমিল মালিকদের কাছে পাট বিক্রি করেন ব্যবসায়ী মেহের আলী। তিনি জানান, গত বছরের চেয়ে এ বছর পাটের দাম প্রতি মণে এক হাজার টাকা কম। গত বছর এই সময়ে ৩ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে পাট কিনেছেন তিনি। বর্তমানে হাটে সর্বোচ্চ ভালো মানের পাট ২ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে কেনাবেচা হয়েছে। এর থেকে নিচু মানের পাট বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। পাটকল মালিকরা ২ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ২৫০ টাকা দরে পাট কিনছেন। এর বেশি দামে তারা পাট কিনছেন না। পাটকল মালিকদের কাছে বেশি দাম চাইলে তারা পাটভর্তি গাড়ি ফিরিয়ে দিচ্ছেন। পাটকলের মালিকরাই দাম কমিয়েছেন।

দুর্গাপুর উপজেলা হাটে আসা পাট বিক্রেতা সেলিম হোসেন বলেন, এই দামে পাট বিক্রি করে কৃষকের লোকসান হচ্ছে। এ বছর পাটচাষে কৃষকের বেশি খরচ হয়েছে। কীটনাশকের দাম বেশি। বৃষ্টিপাত হয়নি। এসব কারণে পাটের ফলন কম হয়েছে। তার ওপরে আবার পাটের দাম কম। পাটচাষে খাটনি হিসেবে টাকা নেই কৃষকের। এই দামে পাট বিক্রি করে টাকা উঠবে না। এই পাটের বাজার ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা মণ বিক্রি করতে পারলে কৃষকের কিছু টাকা লাভ হতো।

রাজশাহী জেলার বিভিন্ন হাট থেকে পাট কেনেন মাহাবুবুল আলম। তার পুঠিয়ার বানেশ্বর হাটে পাটের আড়ত রয়েছে। পাটের ব্যবসার সঙ্গে তিনি ১২ বছরের বেশি সময় ধরে জড়িত। তিনি ব্যবসায়ী হলেও তার কথায় উঠে এসেছে কৃষক পাটের দাম কম পাচ্ছেন। মাহাবুবুল আলম জানান, পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষকরা। গত বছর মৌসুমের শুরুতে ৩ হাজার টাকা মণ দরে পাট কিনেছেন তিনি।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন জানান, এ বছর জেলার ১৯ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় ৪৪২ হেক্টর বেশি জমিতে পাটচাষ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় প্রতি মণে এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পাটের দাম কম। যেসব দেশ বাংলাদেশের কাঁচা পাটগুলো কেনে, তারা বিশ্বমন্দার কারণে পাট কিনছে না। ফলে দেশের পাট রপ্তানি করা যাচ্ছে না। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা যাচাই-বাছাই করে পাট কিনছেন।

সূত্র : আমাদের সময়

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles