9.7 C
Toronto
শনিবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৫

ডিটেকটিভ কালা চাঁদ

ডিটেকটিভ কালা চাঁদ - the Bengali Times
কালা চাঁদকে গ্রামের সবাই ডিটেকটিভ হিসাবেই জানে অনেকের অনেক সমস্যার সমাধান করে

পুকুর পাড়ে বসে মাছরাঙাদের ছো মেরে মাছ শিকার করা দেখছিল কালা চাঁদ। পাখিগুলোর নিপুন কসরত দেখে মুগ্ধ হবার চাইতেও বেশি হচ্ছিল বিস্মিত।
নীরবতা ভেঙে পাশ থেকে জুলহাস ডাক দিলো, ভাইজান
– কী?

– পাশের গ্রামের চেয়ারম্যানের পরিবার আপনার সাহায্য চায়। গত সপ্তাহে ক্যান্সারে মারা গেছে চেয়ারম্যান। তার ব্যাংক একাউন্টের পাসওয়ার্ড খুব দরকার। পাওনাদাররা এসে ভিড় জমাচ্ছে। ধান চালের আড়তের মালিক ছিলো ভদ্রলোক। আড়তে প্রতিদিন টাকার দরকার, কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে আছে।চেয়ারম্যান বলেছিল মৃত্যুর আগে সব ব্যবস্থা করে যাবেন। কিন্তু তার আগেই হঠাৎ মারা যান
– সন্ধ্যায় যাবো।- বলে দুই হাত দিয়ে পুকুরের কিছু ময়লা পানি ছড়িয়ে নিয়ে টুপ করে ডুব দিলো সে।
.
জুলহাস ঘাট থেকে উঠে চলে গেলো। সে জানে কালা চাঁদ এখন সহজে আর পানির তলা থেকে উঠবে না। পাক্কা আড়াই মিনিট পানির তলায় থাকার রেকর্ড আছে তার। পানির তলায় অতক্ষণ করেটা কী? জটিল সমস্যা নিয়ে ভাবে? পানির তলা কি চিন্তা করার উপযুক্ত স্থান?
জুলহাসের কাছে অবশ্য কালা চাঁদ মহামানব গোত্রের মানুষ।
.
.
কালা চাঁদকে গ্রামের সবাই ডিটেকটিভ হিসাবেই জানে। অনেকের অনেক সমস্যার সমাধান করে। পাড়ার লোকজন খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখে তাকে। তার ছোট্ট টিনের ঘরটায় বই এ ঠাসা। আগাথা ক্রিস্টি, ডরোথী সয়্যার, আর্থার কোনান ডয়েলের যাবতীয় বই। এ ছাড়া আরো জনা পঞ্চাশেক রাইটারের বই আছে। টাকার অভাবে বুক শেলফ কিনতে পারে না। দুটা কাঠের নড়বড়ে টেবিলে স্তুপ করে বই রাখা। আর বাঁশের সস্তা দুটা শেলফে আছে বাকি অর্ধেক বই। শেলফগুলোর অবস্থা খুব নাজুক, ঘুণে ধরা। যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। আর আছে উনিশশো ষাট সালের একটা ভাঙাচোরা রাশান টেলিস্কোপ। মহাবিশ্ব নিয়ে তার কৌতুহলের শেষ নাই।
.
.
কালা চাঁদ চেয়ারম্যানের বাসায় আসতেই তার বড় ছেলে জুবায়ের বৈঠকখানায় ডেকে নিয়ে বসিয়ে আপ্যায়ণ করল। উনি মারা যাবার আগের মুহূর্তগুলো বলতে লাগলো। সবাই এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
ভাই, উনি বুঝতে পারছিলেন যে মারা যাচ্ছেন
– মৃত্যু শয্যায় সবাই উপস্থিত ছিলেন? আপনাদের সাথে শেষ কথা কী হয়েছিল?
– হ্যা, সবাই ছিলাম। উনাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যদি কিছু জানিয়ে রাখা লাগে, আমাদের যেন বলে যান

- Advertisement -

– কিছু বলেননি?
– না। তারপর কানে কানে তওবা পড়ানো হলো
– তওবা পড়ানোর কতক্ষন পরে মারা যান?
– তাও প্রায় আধা ঘন্টা?
– উনার শেষ কথা কী ছিল?
– আমার ফুপাতো ভাই আব্বাকে বলল, আপনার ই-মেইল, ব্যাংক, মোবাইলের কোনো পাসওয়ার্ড বা কোনো কোড বলার থাকলে বলতে পারেন

– উত্তরে কী বললেন?
– বললেন, আমি কিছু জানি না
– উনার অনলাইন একাউন্ট কে খুলে দিত?
– এটাও আমরা জানা নেই
– উনার ঘরটায় আমি একটু যেতে পারি?
.
.
জুবায়ের কালা চাঁদকে চেয়ারম্যানের ঘরে আনলেন। সারা দেয়াল জুড়ে অনেক মর্মবাণী লিখা। সে বেশ কিছুক্ষন টাঙানো বাণীগুলো পর্যবেক্ষণ করে বলল, উনার ফেইসবুক একাউন্ট আছে না?
– আছে
– উনার মোবাইলটা একটু দেখতে পারি? লক খুলতে পারেন আপনারা?
– তা পারি। দিচ্ছি
– উনার ইমেইল কয়টা ছিল কেউ জানে?
– দাঁড়ান জিজ্ঞেস করে আসি।
.
সারা দেয়াল জুড়ে অনেক বিখ্যাত মানুষের বাণী লিখা। সক্রেটিসের একটা বাণী কালা চাঁদের খুব মনে ধরলো। সেখানে সক্রেটিস বলেছেন, “আমি জানি আমি জ্ঞানী, কারণ আমি এটা অন্ততঃ জানি যে আমি আসলে কিছুই জানি না”। বোঝা যাচ্ছে “জানা-জানি, জ্ঞানচর্চা” নিয়ে তার ছিল বেশ আগ্রহ। জ্ঞানচর্চা নিয়েই বেশিরভাগ বাণী।

হঠাৎ চেয়ারম্যানের ছোট বোন এসে দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকে ফুঁপিয়ে চাপা কান্না করে বলতে থাকে, আমার ভাই মরার কথানা কালা.. এতো তাড়াতাড়ি তার মরার কথা না রে ভাই.. আমি নিজের গয়না বেচে টাকা দিসি গো ভাই…
জুবায়ের এসে তার ফুপুকে খানিকটা জোর করেই নিয়ে গেল..
.
মিনিট দশেক পরে জুবায়ের আসলো একটা চিরকুট নিয়ে। তাতে ই-মেইল এড্রেস লিখা। বলল- উনার একটাই ই-মেইল।
– আমি কিছুক্ষন এ ঘরে দরজা এঁটে থাকলে সুবিধা আছে? এই ধরেন ঘন্টাখানেক?
– অসুবিধা নাই, আপনার কাজ হলে বৈঠকখানায় আসবেন।
.
কালা চাঁদ চেয়ারম্যানের ঘরটা বেশ খানিক্ষন পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তারপর কাগজ কলম নিয়ে বসে কিছু শব্দ লিখে আবার কাটাকুটি করলেন। চেয়ারম্যানের মোবাইলে ই-মেইল এড্রেস পুট করে প্রাথমিকভাবে উদ্ধার করা সম্ভাব্য একটা পাসওয়ার্ড দিতেই মোবাইলে নোটিফিকেশন আসলো। কোড নিয়ে পুট করতেই ফেইসবুক একাউন্ট ভেসে উঠলো। সৌভাগ্যক্রমে ব্যাংক এর এপ্স এ ইউজারনেম সেভ করা ছিলো। তিনবারের চেষ্টায় একাউন্টও খুললে ফেলল!
.
কালা চাঁদ বৈঠকখানায় ফিরে গিয়ে বলল, আপনারা শুধু চার ভাই-বোন খালাম্মাকে নিয়ে আসেন।
তারা সবাই আসলো।
কালা চাঁদ ছোটখাটো একটা লেকচার দিয়ে বলল- ফেইসবুক, ইমেইল, ব্যাংক একাউন্ট আমি খুলতে পেরেছি। পাসওয়ার্ড দিয়ে দেব। আপনাদের সবার সামনে উনার অনলাইন ব্যাংক একাউন্ট খুলে দেখাবো। আপনাদের সবাইকে একসাথে এখানে ডাকার কারণ ওখানে কত টাকা আছে সবাই দেখবেন। স্বচ্ছতা প্রয়োজন।
.
সম্মতিক্রমে মোবাইলে ওপেন করে সবার সামনে মেলে দিয়ে বলল, দেখেন কত টাকা আছে।

একে একে মোবাইলটা সবার হাতে ঘুরে আসার পর কালাচাঁদ একটা স্ক্রিন শট নিয়ে চার ভাই-বোনের নাম্বারে পাঠিয়ে দিয়ে বলল, আমার দায়িত্ব শেষ। এখন আমি থাকা অবস্থায় আপনারা পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে নেন। কারণ আমি বহিরাগত। আমার পাসওয়ার্ড জানা উচিত নয়; আমি জানতেও চাই না। জুবায়ের আপনি করেন।
.
চেয়ারম্যানের ছেলে পাসওয়ার্ড চেন্জ করবার সময় বলল, পুরানা পাসওয়ার্ড?
– আমি জানি না
– মানে! আপনি ফেইসবুক, ব্যাংক একাউন্ট খুলে ফেললেন। আর বলছেন জানেন না?
– “আমি জানি না”, এই তিনটা ওয়ার্ড নিয়েই পাসওয়ার্ড। উনি মৃত্যুর আগে খুব সম্ভবত এই সেন্টেন্সটাই উচ্চারণ করে গেছেন, তাই না? শুধু প্রথম অক্ষরটা বড় হাতের দিবেন ইংরেজিতে; Amijanina। এবার শক্ত পাসওয়ার্ড দেবেন।
আগেরটা ছিল ঠুনকো।

কালা চাঁদ তার বাবার সত্তর বছর আগেকার জং ধরা বেশ মজবুত মেইড ইন ইংল্যান্ড ৱ্যালি বাইসাইকেলটি নিয়ে চলা শুরু করল। বাজারে ঢুকে দুটা মিডিয়াম সাইজের টাকি মাছ, কিছু লাউ শাক কিনে বাসায় ঢুকলো। সে নিজেই রান্না করে, দুই বেলা আহার করে। শুকনো লিকলিকে শরীর। লম্বায় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি।সে বিয়ে করেনি। করবার সম্ভাবনাও কম। বয়স বেয়াল্লিশ। চেহারায় তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই, তবে চোখ জোড়া খুব উজ্জ্বল, সারাক্ষণ কথা বলে। সারাদিন মাঠে কাজ করার ফলে রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রং। তার বিঘা তিনেক জমি অবশিষ্ট আছে। মৌসুমী সবজি ফলন করে।

তার সবজির বাম্পার ফলন দেখে সবাই বিস্মিত না হয়ে পারে না। কোনো কীটনাশক, কৃত্তিম সার বাদে কীভাবে এরকমপ ফসল ফলায়? সে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে পুরস্কার পেয়েছে বেশ ক’বার। সে শেয়ারও করে, লোকজন তবুও কৃত্তিম সার আর কীটনাশকের ওপর নির্ভরতা থেকে বেরোতে পারছে না। মানুষ প্রাথমিকভাবে প্রাকৃতিক সার এ আস্থা রাখলেও পরে কোনো এক রহস্যজনক কারণে আর মানে না। হয়তো ব্যাবসায়ীদের প্ররোচনায়।

ভাত চুলায় দিয়ে মাছ কেটে, সেদ্ধ করে, পেঁয়াজ-মরিচ কেটে রেখে, ঢাকনা দিয়ে ছুটলো জুলহাসের বাড়ির দিকে। সন্ধ্যায় এসে সে ভর্তা করে জুলহাসকে নিয়ে একসাথে খাবে। সে প্রতিদিন তার সাথে রাতের খাবার খায়।

জুলহাসের মাটির উঠোনে মাদুর পেতে বসল। জুলহাসও রেডি ছিল। একতারা হাতে গাইতে শুরু করলো-
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
আট কুঠুরী নয় দরজা আটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।
তার উপরে সদর কোঠা,
তার উপরে সদর কোঠা,
আয়না মহল তায়।
কেমনে আসে যায়,
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে..”
এ গানটা সে বারবার শোনে।

যতবার শোনে, তত লালনের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়তে থাকে। জীবন রহস্য সম্পর্কে আরো কৌতূহল জাগে। তার কাছে লালন শাহ্ হলেন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ। লালন যতটা জীবনের রহস্য উদ্ধার করে গেছেন বা চেষ্টা করে গেছেন, এ বিশ্বে আর কেউ ততটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। তাকে যদি বর দেওয়া হতো, সে নিঃস্বন্দেহে লালনের সাথে দেখা করতে চাইতো।
.
রাতে ঘুমানোর আগে কালা চাঁদ লেখিকা আগাথা ক্রিস্তির Murder On The Orient Express গল্পটার কিছু পৃষ্ঠা ওল্টাতে থাকে। সময় পেলেই সে পাতা ওল্টায়। আগাথা ভদ্রমহিলার নিখুঁত চিন্তা করবার ক্ষমতা, গল্পের অভাবনীয় টুইস্ট তাকে বিস্মিত করে। গোয়েন্দা গল্পের প্রধান আকর্ষণই হলো টুইস্ট বা মোড় ঘোরানো। এ গল্পের সারমর্ম হলো- আন্তঃদেশী ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টের এক কেবিনে একজন খুন হয়।

যার শরীরে প্রায় ডজনখানেক ধারালো চাকুর ক্ষত। শেষে গোয়েন্দা হার্কিউল কয়েকদিনের এ ট্রেন জার্নিতে উদ্ধার করেন যে ট্রেনের বারো জন যাত্রীরা সবাই আসলে খুনি। ডেইজি নামের বাচ্চা মেয়ের অপহরনকারী আর হত্যাকারী ছিল ঐ খুন হওয়া লোক। মুক্তিপণ পাবার ভরসা পেলেও সে খুন করে বসে। আইনের ফাঁক-ফোঁকর গলে বেরিয়ে এসে পলায়নরত এ খুনিকে ট্রেনের যাত্রীটা প্রবল ঘৃণা নিয়ে নিখুঁত পরিকল্পনা করে খুন করে। সম্মিলিত প্রতিশোধ আর মেয়েটার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ থেকে।

কালা চাঁদ দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ঘুমাতে যায়; তাই বলে চেয়ারম্যানের ছেলেরা তার বাবাকে খুন করলো? কেমোথেরাপি, ওষুধের খরচ বাঁচাতে জমিজমা বিষয়-সম্পত্তি বিক্রি বন্ধ করলো!

তার কানে বারবার বাজতে থাকে বোনের আহাজারি; প্রিয় রক্তের ভাইয়ের জন্য!
এসব তার অসহ্য লাগে..
কালা চাঁদের অবশ্য ভাই বোন নেই। সে কোনোদিন জানবে না ভাই বোনের স্নেহ মমতা কি জিনিস।
তার একটা আফসোস।

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles