
বাবা, তুই এতো দেরি করে ফোন দিস কেন?
আম্মা ফোন ধরে অভিযোগের সুরে বলল।
মায়ের সাথে কথা বলার সময় চারপাশটা ঠিক যেন ছবির মতো ভেসে উঠে। বাড়ির দরজা, চৌকাঠ, জানালা, বিছানা, রান্নাঘর, ছাদের গাছ, সাদা-নীলচে নয়নতারা, মেলে দেয়া কাপড়, পাড়ার রাস্তা, গাছ-গাছালি; সব যেন স্পষ্ট দেখতে পাই। মনে হয় যেন আমি কুষ্টিয়ায় বসে আছি মায়ের সামনে। যেন তার বিছানায় আরাম করে পা তুলে তার সাথে সুখ-দুঃখের গল্পে মেতে উঠেছি। স্পষ্ট অনুভব করি বাড়ির গন্ধ, বাতাস।
.
মিনিট দশেক কথা বলার পর ফোন রাখার সময় হয়ে আসে। আর কথা খুঁজে পাই না। বললাম, রাতে কী খাবা?
– তোর ভাই ঘাইরো মাছ কিনছে
– সেই গু খাওয়া মাছ?
– সে তো সব মাছই খায়, দোষ হয় এ মাছের..
– হঠাৎ এই মাছ?
– তোর ভাইয়ের দেখে নাকি ভাল্লাগছিল। সহজে পাওয়াও যায় না আর। যুক্তি দেখায়ে বলল মাছের স্বাদটাই নাকি আসল, কী খায় না খায় সেইটা জেনে লাভ কি। সাতশো টাকা কেজি। আজকালকার টয়লেটগুলা নাকি পাকা; ওসব খাওয়ার নাকি উপায় নাই
– ওর যুক্তির শেষ নাই
– ভাবলাম ঠিকই তো বলছে। অবশ্য মাছের পেটে কিছু ছিল না
– আমার মনে আছে, আগে না বুঝে কিনে ফেলেও দিতে হতো। দেখতে অবশ্য এর চাইতে সুন্দর মাছ আর নাই
– আমার কি মনে হয় জানিস, এ মাছ ঐসব হাবিজাবি খায়ে হজম করতে পারে না
– কেমনে বুঝলা?
– ও মা, তা না হলে পেট ভর্তি টুপটুপ করতো কেন..
– বেশি খাইলে তো বিরিয়ানিও হজম হয় না। স্বাদ কেমন?
– আগের সেই স্বাদ পাই নাই
– মাইনসের গু না খাইলে এ মাছের স্বাদ আসে না
– তোর যত সব আজগুবি কথা। তুই কি অফিসে?
– হু, কাজে। আজকে রাখি আম্মা
– আচ্ছা রাখ। কী খাইলি?
– এই.. একটা স্যান্ডুইচ
– আচ্ছা, তুই যে ঐগুলা লিখিস, আসলেই কি রাত জেগে খাস?
– বলা যাবে না
– না বলিস। তুই কি ভাবছিস আমি শোনার জন্য পাগল হয়ে আছি? তোর কোলেস্টেরল বাড়াস না, সাবধানে খাস
– ঠান্ডা একটু কমলো?
– কমছে, রাতের বেলায় চাদর গায়ে দি
– ভালো। আমাদের আজকে ৩০ ডিগ্রি গেল। অনেক আরাম। আচ্ছা রাখি
– রাখবি? আচ্ছা রাখ। আর রাতের বেলায় ওভাবে মরিচ তুলতে ব্যাকইয়ার্ডে যাবি না
– আচ্ছা
– আমার তিনটা পেঁপে আর একটা আতা গাছ হইছে বড় টবে
– বলো কি!
– পেঁপে ধরছেও
– বারান্দায় বুলবুলি পাখির বাসা এখনো আছে?
– না কবে উড়ে গেছে! রিপন রে..
– বলো
– কাল তোকে স্বপ্নে দেখলাম ইভান পৌঁছানোর পর তুই আমার পাশে দাঁড়ায়ে আছিস। ইভানকে এই মাসের শেষে পাঠাবে। তুই যে কেন এতো দূরে চলে গেলি!
.
.
আমরা ভাষা হারিয়ে ফেলি।
আমার ভাস্তে কে দেশে পাঠানো হবে ফিনল্যান্ড থেকে। তার বাবা-মায়ের, বোনের পরিস্থিতি তো বলাই বাহুল্য..। আম্মা কীভাবে সহ্য করবে তাকে দেখে? তার বড়ো নাতনি, বুকের ধন পড়তে গিয়েছিল কতো আশা নিয়ে। আর ফিরবে কফিনে করে!
.
.
আমার কলিগরা মাঝে মাঝে আমাকে অন্যমনস্ক হতে দেখে জিজ্ঞেস করে, “যাভিড, আর ইউ ওকে?
আমরা কেও আসলে ওকে নই।
বাস্তবতায় ভালো থাকার চেষ্টা করি। খুব ইচ্ছে হচ্ছে এ দু:সময়ে দেশে গিয়ে তাদের পাশে থাকি। কি অসহ্য এক সময়!
মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে দুই হাত তুলে বলি- বাবা মায়ের স্বাভাবিক মৃত্যুর আগে কারও সন্তানকে তুলে নিও না যেন..
আমরা মা-ছেলে চুপ থেকেও মনে মনে অনেক কথা বলি।
আবার বললাম, আম্মা আজকে রাখি..
অটোয়া, কানাডা