বাহিরে তখন ঝুম বৃষ্টি ! গাড়ির উইন্ডশীল্ড ছাপিয়ে বৃষ্টিকণার হিমশীতলতা যেন শরীর ভেদ করে মনও ছুঁতে চায় ! সূর্যের উষ্ণতা আর আলো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে কালো মেঘের অন্তরালে ! জীবনের গতিবেগ ঘন্টায় একশ দশ কিলোমিটার ! ফিরে চলেছি চেনা গন্তব্যে, চেনা শহর্ আপন নিবাসে। মননে মগজে গত ৭২ ঘন্টার টুকরো টুকরো স্মৃতি কথোপকথন, ভাবনা, সম-মনা সহযাত্রীদের আলাপন ! মস্তিষ্কে এই চিন্তা কতটা দ্রুত বেগে চলছে তা নির্ণয়ের যন্ত্র এখনো আবিষ্কার হয়নি তাই তা বলতে পারছি না কত দ্রুত চলছে এই ভাবনার গতি !
স্টিয়ারিং হুইলের পিছে বসে প্রসারিত দৃষ্টিতে মস্তিষ্ক প্রতিফলিত করছিল প্রিয় বন্ধু ও অনন্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর আসিফ চৌধুরীর ছল ছল চোখ। মমতায় জড়িয়ে ধরা উষ্ণতার অবগাহন, সেই সাথে তার হারানোর বেদনা। নিঃসীম হাহাকার কানে বাজছিল “কিচ্ছু করতে পারলাম নারে – আব্বু চলে গেলো !” সেই সাথে এই দীর্ঘদেহী মানুষটির হৃদয় যে কতটা দীর্ঘ – তা ভেবে বারবার নিজের মনে নিজেই নত হচ্ছিলাম – এই প্রিয় বন্ধুর গভীর ভালোবাসার বিশালতায় ! পিতার জন্য তাঁর যে ভালোবাসা আর যত্ন তার বোধ করি জুড়ি মেলা ভার ।
মনে হচ্ছিলো একজন আসাদ চৌধুরী, একজন কবি , একজন যোদ্ধা , একজন সমাজ সেবী , একটি জাতির প্রতিফলিত মানুষ, সর্বোপরি একজন “সময় উত্তীর্ণ মানুষ”। যাকে আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানবার চেষ্টা করব , বুঝবার চেষ্টা করব। এবং ছড়িয়ে দেব তাঁর চিন্তার ব্যপ্তি, তাঁর মন মনন ও সৃষ্টিশীলতার দর্শন , বয়ে নিয়ে বেড়াব তাঁর ওড়ানো মানবতার ঝান্ডা পৃথিবীর এই গোলার্ধ্ব থেকে ঐ গোলার্ধ্ব ! আসাদ চৌধুরীরা কখনো হারিয়ে যায় না। তাঁরা রয়ে যায় আমাদের চিন্তা চেতনায় মননে এবং কল্পনায় সৃষ্টিশীলতার আলোকবর্তিকা হয়ে। তেমনি একজন মানুষের সংস্পর্শ তাঁর ছায়া প্রচ্ছায়ায় আমরা যারাই বেড়ে উঠেছি বা উঠেছিলাম, দায়বদ্ধতার অবস্থান থেকে তাঁর জীবন তাঁর কর্ম তাঁর দর্শনকে উদযাপনের গুরু দায়িত্ব কখনোই অবহেলার নয় ! এই মানুষটি সেই মানুষ যে তাঁর দেহ ত্যাগ করবার আগ পর্যন্ত জীবনের কথা বলেছেন, মানুষের কথা বলেছেন ! যাঁর চিন্তা চেতনা ও অবচেতন মনে ধরা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, কীটস, শেলী, নজরুল কিংবা জীবনানন্দের মত অতিমানবেরা ! রুদ্রের কবিতার পংক্তি বারবার বাজছিল-
“চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়,
বিচ্ছেদ নয় – নয় বন্ধন ছিন্ন করা আর্দ্র রজনী”
বাহিরের অন্ধকারের ঘনত্ব বেড়েছে, নিকষ কালো আঁধার গ্রাস করেছে মহাসড়কটি, দৃষ্টি আরো প্রসারিত হয়, মস্তিষ্কে নিউরনে চিন্তার গতি বাড়ে যার পরিমাপ জানা নেই। মনে পড়ছে টরেন্টো শহর তথা উত্তর আমেরিকার বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব আহমেদ হোসেনের কথা , যিনি বারবার সাহস দিয়ে বলছিলেন “দ্য শো মাষ্ট গো অন”- কবি আসাদ চৌধুরীর জীবন এবং দর্শন উদযাপনের এই মহতী সন্ধিক্ষণ যেন বিঘ্নিত না হয়। তিনি আছেন তিনি থাকবেন সেই উদযাপনে। বলছিলেন হাসান মাহমুদ -আসাদ ভাই এর মত একজন মানুষকে দুই শব্দে বেঁধে রাখা কঠিন, তবুও আমার স্মৃতি থেকে তাঁর জীবণ এবং কর্ম উদযাপনে আমি তোমাদের সাথে এক কাতারে দাঁড়াতে চাই। তেমনি এক দায়বদ্ধতা থেকে সাড়া দিয়ে শোকাহত প্রিয় মানুষ আসিফ চৌধুরী এসেছিলেন জানাতে একজন বাবা, একজন কবি, একজন সময়োত্তীর্ণ মানুষ তথা একজন আসাদ চৌধুরীকে আমাদের সামনে তুলে ধরতে !
নিজের অজান্তেই বারবার অশ্রুসজল হয়ে যাচ্ছিলাম। বাহিরের বৃষ্টি অস্বচ্ছ উইন্ডশীল্ড,অশ্রুসজল চোখ খুব বেশীদূর এগোতে দেয়নি। মহাসড়কের পাশে গাড়িখানা দাঁড় করিয়ে সময় দিলাম নিজেকে , সময় দিলাম প্রকৃতিকে কিছুটা স্থির হবার ।
ঘন্টাখানেকের বিরতির পর চলমান রাস্তায় চিন্তাসূত্র আবার নিয়ে গেল গত ৭২ ঘন্টায় ঘটে যাওয়া টুকরো টুকরো স্মৃতির মেঘমালায়। ভাবলাম বলতে চাই অভিযোগ নেই, অভিমান নেই ,অনুযোগ নেই, নেই ভুল বোঝার অবকাশ। ভাবলাম জাতিসত্ত্বার কবি নুরুল হুদার সেই পংক্তিমালার কথা -“যতদূর বাংলাভাষা ততদূর এই বাংলাদেশ” আমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই ছড়িয়ে থাকি না কেন ,ভৌগোলিক যে অবস্থান থেকেই যুক্ত হই না কেন আমাদের এই চিন্তা, আমাদের ভিন্ন মত – আমাদের যুক্ত করে অভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছাতে, আমাদেরকে আমরা করে তোলে , করে তোলে বাঙালি । তাই উদাত্ত কণ্ঠে আবারো বলতে চাই নেই কোনো অভিযোগ, নেই কোনো অভিমান, নেই কোনো অনুযোগ, নেই কোন অনুশোচনা, নেই কোন পাপ বোধ, কিংবা স্খলনের শঙ্কা – উদযাপ করেছি একজন আসাদ চৌধুরীকে – যার বিদায় ঘোষণায় বন্ধু নাদিম লিখেছিলো “মৃত্যু হায়নাদের মতো তাঁর পিঁছু লেগেছিল অনেকদিন ধরেই কিন্তু তিনি ছিলেন সিংহরাজ। সহজে হার মানেননি, তাঁর নামের অর্থও তাই। সবার টান টান উত্তেজনা আর শুভ প্রত্যাশার অগুনিত তারগুলো ছিঁড়ে গেছে। He lived a great life! Please pray for his departed soul!” ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখে পড়ছিল গত কয়েকদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা ! যাতে সবার অনুভূতি ও অনুভবের প্রকাশ দেখেছি এক ও অভিন্ন ভালোবাসার প্রকাশে , যা প্রকাশিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ! কবির প্রতি তথা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে সকলেই ছিলেন একমত । সেই সাথে হৃদয়ের গভীর থেকে বারবার উঠে এসেছিল মমত্ববোধ তাঁদের জন্য যারা ভিন্ন মাত্রায় প্রাকশ করেছেন তাঁদের চিন্তা ! যার অনুভব আমাকে এবং আমাদের উত্তরের জানালায় ঘিরে থাকা মানুষ গুলোকে মনে করিয়ে দিয়েছে কবির প্রতি আমাদের সবার ভালোবাসা এক ও অভিন্ন এবং কতটা প্রগাঢ়। সময়টা একবিংশ শতাব্দী ! এই শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কোনো কাজ লোক দেখানো বা লৌকিকতার ধার কেউই আর ধারেনা বা ধারি না ! নিজের চিন্তা-চেতনা, দর্শন ও ভাবনাকে, নিজের অবস্থান থেকে বড্ড স্পষ্টভাষায় দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করি বা করে থাকে সবাই !
সেই সাথে আমার কৃতজ্ঞতা এবং আমাদের কৃতজ্ঞতা সময়োত্তীর্ণ একজন মানুষ , একজন কবি , একজন আসাদ চৌধুরীকে উদযাপনের জন্য টরেন্টোর ভৌগোলিক অবস্থানে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য Member of Provencial Perliament Ms. Doly Begum, বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব আবৃত্তিকার সংগঠক আহমেদ হোসেন, সংগঠক আবৃত্তিশিল্পী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মেরী রাশেদীন (যিনি আমাদের জন্য বাচনিকের দশবছর পুর্তির অনুষ্ঠান উদযাপন বিলম্বিত করেছেন), বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কবি এবং অভিভাবক হাসান মাহমুদ, দেশে-বিদেশে টিভির অধিকর্তা নজরুল মিন্টো (যিনি বিলম্বিত করেছেন তাঁদের নির্ধারিত আয়োজন আমাদের আয়োজনকে এগিয়ে দিতে ) , NRB TVর অধিকর্তা শহিদুল ইসলাম মিন্টু , নন্দন TVর অধিকর্তা নীল উৎপল, আলোকচিত্রি বিদ্যুৎ সরকার, প্রিয় বন্ধু কবিপুত্র আসিফ চৌধুরী, কবি তনয়া নুসরাত জাহান শাঁওলী ও জামাতা নাদিম ইকবাল , কবি ও প্রাবন্ধিক রেজা অনিরুদ্ধ, বিশিষ্ট গজল ও সংগীতশিল্পী শোয়েব মর্তুজা, বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী অমিত রায়, প্রধান পৃষ্ঠপোষক ফরিদা হক, যোয়াকিম ভিক্টর গোমেজ, আশরাফ খান, সাবরিন সুলতানা , জামাল হোসাইন ও ফরিদা হক, মোহাম্মদ কায়েস রহমান , ব্যারিস্টার রওশন আরা ইসলাম, ভিকটর রোজারিও, রাহুল সাহা , কল্যানি ইন্ডিয়ান কুইজিন এবং ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক॥ বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রাশেদা মুনীর, হাসি রহমান, রিফাত নূয়েরীন, জানা শাম্মী, আলোকধারায় মিলি, ফারহানা হুদা, ডক্টর মনিরুজ্জামান, জিনাত জাহান টুম্পা, জনি ফ্রান্সিস গোমেজ, মুনিমা শারমীন। কৃতজ্ঞতা নন্দন টিভিকে। কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই কবি কাজী জহিরুল ইসলামকে তাঁর “আসাদ ভাই, যাচ্ছেন ?” কবিতাটি কবির স্মরণে আমাদের আবৃত্তি করবার সুযোগ করে দেবার জন্য !
আরো কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই টরেন্টোর সে সকল অনুরাগী ও ভক্তদের যারা “উত্তরের জানালায়” আয়োজিত কবি আসাদ চৌধুরীর শোকবার্তাতে স্বাক্ষর করেছেন – তাঁদের অভিব্যক্তি জানিয়ে!
“উত্তরের জানালায়” আমাদের সেই অভয়ারণ্য যেখানে আমরা আমাদের চিন্তা -চেতনা ও সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ করে থাকি এবং করে যাব। আপনাদের অনুপ্রেরণা আমাদের চলার পথের পাথেয় আমাদের প্রাণ শক্তি।
স্বগোতক্তির এই রেশ কাটতে না কাটতেই নিকষ কালো অন্ধকার সরিয়ে উঁকি দেয়া ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় দেখতে পাচ্ছি দূরের দিগন্ত রেখায় চির পরিচিত শহর । পৌঁছে যাচ্ছি খুব দ্রুত আপন আলোয় আপন আবাসে।