
ব্রাজিলের মানুষ ভালোবেসে ‘ও ব্রুক্সো’ নামে ডাকে। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় “যাদুকর”। সেই ফুটবল যাদুকর রোনালদিনহো ঢাকা এসেছিলেন মাত্র সাড়ে ৮ ঘন্টার সংক্ষিপ্ত সফরে। এই মহাতারকাকে কেন এবং কাদের স্বার্থে ঢাকা আনা হয়েছে, এ এক বড় রহস্য। ব্রাজিল ও তাকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উন্মাদনার ছিটেফোঁটাও বুঝতে পারলেন না এই সফরে। তাকে নিয়ে ছিল না কোন উন্মুক্ত আয়োজন। দেশের হাজার হাজার ফুটবল ভক্তকে বঞ্চিত করে ফুটবল যাদুকরকেই যাদুবাক্সে বন্দী করে রেখেছে তার ঢাকা সফরের পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান। এমনকি উপস্থিত সংবাদ মাধ্যমকেও নানাভাবে করা হয়েছে হেনস্থা। যে কারণে তাকে নিয়ে আয়োজকদের রাতের মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগেই সংবাদকর্মীরা এক যোগে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করে।
বিশ্ব ফুটবলে রোনালদিনহো অনেক বড় নাম। ২০০২ সালে বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের সদস্য ছিলেন। তার নান্দনিক ফুটবলে বুঁদ হতে এ দেশের তরুণ প্রজন্ম কতশত রাত যে নির্ঘুম কাটিয়েছে, সেই সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। খেলা ছাড়ার পরও নানা নেতিবাচক কারণে নিয়মিতই শিরোনাম হন রোনালদিনহো। সেই মহাতারকার ঢাকা সফরের পরিকল্পনাটা হয়েছে হুট করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এক ক্রীড়াজীবি শতদ্রু দত্তের মাধ্যমে তিনি এসেছিলেন ঢাকায়। এই ভদ্রলোক এর আগে গত জুলাইতে ঢাকায় এনেছিলেন কাতার বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনা দলের গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজকে। দুই মহাতারকার দুটি সফরেই পরিস্কার হয়েছে, বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমী মানুষের কথা চিন্তা করে শতদ্রু দত্ত এই উদ্যোগ নেননি। তিনি উদ্যোগী হয়েছেন নিছক ব্যবসায়ী স্বার্থের কারণে। দু’বারই কলকাতায় এনে তিনি একাধিক উন্মুক্ত আয়োজনে উপস্থিত করেছেন দুই তারকাকে। তবে ঢাকায় স্বল্প সময়ের জন্য তাদের এনেছেন কেবলমাত্র যে প্রতিষ্ঠানগুলো তার ছোট্ট সফর হাজার হাজার ডলারের বিনিময়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে। আর বাংলাদেশের পৃষ্ঠপোষকরা স্বল্প সময়ে মার্তিনেজ-রোনালদিনহোদের মালিকানা পেয়ে একেবারেই নিজেদের বৃত্তেই বন্দী করে রেখেছে।
গতকাল রোনালদিনহোর ঢাকা সফরের স্পন্সর ছিল স্পোর্টস পানীয় ব্র্যান্ড ব্রুভানা। বেলা সাড়ে ৩টায় ঢাকার বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রোনালদিনহো ও তার সফরসঙ্গী শতদ্রু দত্তকে তারা নিয়ে যায় রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে। হোটেল লবিতে কিছুক্ষণ আয়োজকদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে নিজ কক্ষে বিশ্রাম নেন ব্রাজিল তারকা। এরপর ঠিক সাড়ে ছয়টায় হোটেল ছেড়ে তিনি যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে। এর আগে থেকেই সেই হোটেলে জড়ো হয়েছিলেন সংবাদকর্মীরা। যেহেতু রোনালদিনহোকে নিয়ে কোন উন্মুক্ত আয়োজন নেই, তাই সংবাদমাধ্যমে যাতে দেশের মানুষ রোনালদিনহোর ঢাকা সফরের খবর পান, সে কারণেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করে গিয়েছিলেন সংবাদকর্মীরা। রোনালদিনহো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে হোটেল ছাড়ার পর সংবাদকর্মীদের অনুমতি মিলেছিল রাতের মূল অনুষ্ঠানস্থলে। তবে অডিটরিয়ামে সাংবাদিকদের জন্য কোন জায়গা বরাদ্দ করে রাখেনি আয়োজকরা। শেষের দিকের তিন সারিতে সংবাদকর্মীরা আসনগ্রহণ করার পর থেকেই মঞ্চের মাইক থেকে বারবার আসন ছেড়ে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে বলেন অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা। এক পর্যায়ে এ নিয়ে প্রতিবাদ করেন সংবাদকর্মীরা এবং অনুষ্ঠান বয়কট করে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। সংবাদকর্মীদের এই অবস্থানের কথা জানতে পেরে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলও হোটেলে পৌঁছেও অনুষ্ঠানে অংশ নেননি।
গত জুলাইয়ে একই রকম ঘটনা ঘটেছিল এমিলিয়ানো মার্তিনেজের ঢাকা সফরের দিন। আর্জেন্টিনাকে ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জিততে বড় ভূমিকা রাখা মার্তিনেজের ঢাকা সফর স্পন্সর করা ফান্ডেড নেক্সটও সাধারণ ভক্ত-সমর্থকদের নিয়ে রাখেনি কোন আয়োজন। ছিল না কোন মিডিয়া সেশন। তবে তাতে কিছুই আসে যায় না শতদ্রু দত্তের। তার ব্যবসা তো ঠিকই হয়েছে দু’প্রস্থেই। এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় বিরক্ত হয়েছেন খোদ ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীও। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে এমন আচরণের পর তো ওই অনুষ্ঠানে আমার যাওয়া মানায় না। এটা ভীষণ অনাকাঙ্ক্ষিত।’
২০০৬ সালে ঢাকায় দু’দিনের সফরে এসেছিলেন ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ জেতানো মহাতারকা জিনেদিন জিদান। সেই সফরে তিনি মিশে গিয়েছিলেন এ দেশের মাটি-মানুষের সঙ্গে। নানা আয়োজনে সেই সফরটা স্মৃতিতে এখনো ধরে রেখেছেন এ দেশের ফুটবলপ্রেমী মানুষ। তার সঙ্গে এক মাঠে ফুটবল খেলতে পারা এ দেশের অনেক তরুণের সেরা অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। জিদানও সেই সফরে এসে ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উন্মাদনাটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। ২০১১ সালে গ্যালারিভর্তি মানুষের সামনে পুরো ৯০ মিনিট ম্যাচ খেলে একইরকম অনুভূতি পেয়েছিলেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি। ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী দলের গোলকিপার হুলিও সিজারও এসে পেয়েছেন অকৃত্রিম ভালোবাসা। তবে মার্তিনেজ, রোনালদিনহোদের কাছে এ দেশের মানুষের ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাটা অজানাই থেকে গেছে কেলবমাত্র কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সিধ্যির কারণে।