খাদ্য উৎপাদনে বড় হুমকি ইঁদুর। এই প্রাণীটি দেশের উৎপাদিত খাদ্যশস্যের ৫ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি করে থাকে। বছরে গড়ে যার পরিমাণ ১০ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টনের মতো। টাকার অংকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা, বলছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। তথ্য বলছে, উৎপাদিত ফসলের ক্ষেত থেকে গড়ে ৫ থেকে ৭ শতাংশ এবং গুদামজাত শস্যের ৩ থেকে ৫ শতাংশ নষ্ট হয় ইঁদুর দ্বারা। বোরো মৌসুমের চেয়ে আমন ও রবি মৌসুমে দেশে ইঁদুরের উপদ্রব বেশি দেখা যায়। একটি ইঁদুর বছরে একটি পরিবারের গুদামজাত দানা শস্যের ৪০ থেকে ৫০ কেজি পর্যন্ত ক্ষতি করে। ইঁদুরের উপদ্রব এবং ক্ষতির পরিমাণ কম-বেশি সারাদেশেই দেখা যায়। তবে যেসব অঞ্চলে আমন ধান চাষ হয়, সেসব অঞ্চলে তুলনামূলক উপদ্রব একটু বেশি। সেই দিক থেকে দেশের উত্তর অঞ্চল, সিলেট বিভাগ, বরিশাল বিভাগ ও পার্বত্য জেলাগুলোতে বেশি। এর মধ্যে গত বছর শুধু রংপুর অঞ্চল থেকেই প্রায় ১১ লাখের বেশি ইঁদুর নিধন করা হয়।
এদিকে, ইঁদুরের এই ক্ষতি থেকে কৃষকের উৎপাদিত ফসল রক্ষায় প্রতিবছরের মতো এবারও সারাদেশে চলছে জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২৩। ‘ইঁদুরের দিন হবে শেষ, গড়ব সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে গত ৯ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই অভিযান চলবে আগামী ৮ নভেম্বর পর্যন্ত। জানা যায়, ২০২২ সালের অভিযানে ১ কোটি ৬৪ লাখ ৫৮ হাজার ৯২৯টি ইঁদুর নিধন করা হয়েছে, যা থেকে প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার ৪৪২ মেট্রিক টন ফসল রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৪৯৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর আগে ২০২১ সালে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫১৮টি ইঁদুর মেরে ১ লাখ ১ হাজার মেট্রিক টন ফসল বাঁচানো সম্ভব হয়। ২০২০ সালে প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ ৮৪ হাজার ইঁদুর মেরে প্রায় ৮৯ হাজার ৮৭৬ মেট্রিক টন ফসল রক্ষা করা হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা। একইভাবে ২০১৯ সালে প্রায় ১ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার ইঁদুর নিধন করে ৩০০ কোটি টাকার ফসল রক্ষা করা হয়েছিল।
কৃষিবিদরা বলেন, ইঁদুরের কারণে প্রতিবছর দেশে কী পরিমাণ খাদ্যশস্য ও ফলমূল নষ্ট বা ক্ষতি হয় তার সঠিক কোনো হিসাব নেই সরকারের কাছে। তবে বিভিন্ন সময়ের গবেষণা এবং প্রকাশনা থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নানা রকমের শস্য, ফলমূল ও প্রক্রিয়াজত খাদ্য মিলিয়ে এই পরিমাণ ১০ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টনের মতো হবে জানান তারা।
২০২৩ সালে কৃষি বিভাগের প্রকাশিত এক বুলেটিনে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৫০ থেকে ৫৪ লক্ষ লোকের এক বছরের খাবার ইঁদুরের কারণে নষ্ট হয়। বুলেটিনে আরও বলা হয়, ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে ডিম ও ছোট বাচ্চা খেয়ে বছরে প্রতিটি খামারে প্রায় ১৮ হাজার টাকার ক্ষতি করে। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক ব্যাপার হলো, একটি ইঁদুর এক রাতে ২০০ থেকে ৩০০টি ধান বা গমের কুশি কাটতে পারে।
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রের (ইরি) ২০১৩ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৫০ থেকে ৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে ইঁদুর। বছরে বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ ধান-গম ইঁদুর খেয়ে ফেলে এবং নষ্ট করে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জরিপে দেখা যায়, দেশে ইঁদুরের কারণে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫ থেকে ৭ ভাগ, গম ৪ থেকে ১২ ভাগ, গোলআলু ৫ থেকে ৭ ভাগ, আনারস ৬ থেকে ৯ ভাগ নষ্ট হয়। ইঁদুর শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ সেচনালাও নষ্ট করে থাকে। সেটা ফসলের উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলে।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য বলছে, দেশে মোট ১৮ প্রজাতির ইঁদুর দেখা যায়। এর মধ্যে ফসলের ক্ষতিসাধনকারী ইঁদুর হলো কালো ইঁদুর। একটি বড় কালো ইঁদুরের ওজন আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত হয়। একটি ইঁদুর প্রতিদিন তার ওজনের ১০ ভাগ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। আবার সমপরিমাণে খাদ্য বা শস্যদানা কেটে নষ্ট করে। ইঁদুরের মলমূত্র ও লোম খাদ্যের সঙ্গে মিশে ৩০ ধরনের রোগ ছড়ায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ইঁদুর প্রতিবছর বিশ্বের ৩ কোটি ৩৩ লাখ টন খাবার নষ্ট করে। বাংলাদেশে প্রায় ৬০ থেকে ৭৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার ইঁদুরের কারণে নষ্ট হয়। ইঁদুর দ্বারা বছরে ফসল ও অন্য জিনিসপত্রের ১.৫ থেকে ২.০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়।
জানা যায়, ফসলের মাঠ ছাড়াও নদীর অববাহিকায় অবস্থিত হাটবাজার, শিল্পাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় ইঁদুরের বংশবিস্তার বেশি পরিলক্ষিত হয়। সরকারি-বেসরকারি খাদ্য গুদাম, পাউরুটি ও বিস্কুট তৈরির কারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পাইকারি ও খুচরা পণ্য বিক্রেতার দোকানে বিপুল পরিমাণে খাদ্য ইঁদুর নষ্ট করে।
এদিকে, বছরের পর বছর ধরে ফসলের মাঠে ইঁদুর দমন করা হয়ে আসছে, তারপরও এ সমস্যা বড় আকারে দিনের পর দিন থেকে যাচ্ছে। এজন্য সমন্বিত উপায়ে নিয়মিত ইঁদুর দমন কার্যক্রম চালিয়ে ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সম্মিলিতভাবে ইঁদুর দমনের আহ্বান জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কৃষকের উৎপাদিত ফসলের একটি বড় অংশ ইঁদুর দ্বারা নষ্ট হয়। ইঁদুরকে একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত করে এটিকে দমনের ক্ষেত্রে সকলকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে এবং এই দমন কার্যক্রমকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচলক বাদলচন্দ্র বিশ্বাস বলেন, আবহাওয়ার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও সঠিক দমন পদ্ধতি ব্যবহার করে ইঁদুরের আক্রমণ এড়িয়ে ফসল ফলানো সম্ভব। ইঁদুর দমন অভিযানে কৃষকসহ সকলকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে। কেবল সম্মিলিতভাবে ইঁদুর দমন করলেই ইঁদুরের উপদ্রব কমানো সম্ভব।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক মো. ফরিদুল হাসান বলেন, ইঁদুরের সমস্যা দীর্ঘদিনের। এককভাবে ইঁদুর নিধন করার পাশাপাশি অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন।
দেশে ১৯৮৩ সাল থেকে ইঁদুর নিধন অভিযান কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগ। এই কর্মসূচির আওতায় মূলত কৃষকরাই ইঁদুর নিধন করে থাকেন। প্রতিবছর তাদের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক ইঁদুর নিধনকারীদের পুরস্কৃত করা হয়। হিসাব রাখার জন্য তারা নিধনকৃত ইঁদুরের লেজ জমা দিয়ে থাকেন।
সূত্র : আমাদের সময়