
সেদিনের তখনকার সময়টা ছিল ভোর ৪টা বেজে ৪১ মিনিট।
ঘুম থেকে উঠে পরিস্কার হয়ে চা বানিয়ে এক টুকরো কেক নিয়ে টেবিলে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছি আর ফোন খুলে স্বভাববসত ফেইসবুক দেখছি। আর তখনই দেখি বাবু আমাকে নিয়ে কী যেন লিখেছেন! প্রথমে আমাকে নিয়ে বাবুর লেখাটা পড়লাম। লজ্জায় কোথায় নিজেকে লুকাবো খুঁজে না পেয়ে চারিদিকে চেয়ে দেখি কেউ এখন জেগে নেই! সবাই ঘুমিয়ে আছেন। আমাকে কেউ দেখছে না!
বাবু আমাকে বারংবার আশ্চর্য ও বিহ্বলিত করে তুলছেন। এমনিতেই বাবুর কণ্ঠে যে কোন কবিতার মায়াময় উচ্চারণের আবৃত্তি আমাকে মুগ্ধ করে। NRB টিভির একটি অনুষ্ঠানের জন্য বাবুর আবৃত্তি করা কবি মাকিদ হায়দারের কবিতা ‘যে আমাকে প্রেম শেখালো’ শুনে আমি রীতিমতো মুগ্ধতায় ভেসে যাই। এতো সুন্দর, নিখুঁত ও আকুলতাভরা স্বরধ্বনির আবৃত্তি আমার প্রাণে গেঁথে যায়। এখনো আমি কান পাতলে বাবুর সেই আবৃত্তি মাকিদ ভাইয়ের অসাধারণ বুননের কবিতাটি শুনতে পাই। চোখে ভাসে কবিতায় আঁকা গল্পের হৃদয় পুড়ে যাওয়া ছবিখানি!
‘নীরবতাই আমার জবাব’ কবিতাটিতে একটি বাস্তব গল্পের কিছু ছায়া আছে। আমার এক প্রাণপ্রিয় বন্ধুর একটি পোষা পাখি আছে৷ ছোট্ট টিয়া জাতীয় পাখিটি ভারি সুন্দর। কী অপূর্ব সুন্দর তার গায়ের রঙের বাহার। এই ছোট্ট পাখিটি ঘরের এপ্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝেই উড়ে এসে আমার বন্ধুর কাঁধে বসে। একদিন আমার বন্ধু ও তার সন্তান ঘরের বাহিরে বসে সময় কাটাচ্ছে। যথারীতি পাখিটি ওদের সঙ্গে আছে। হঠাৎ পাখিটি পাশের গাছের এ-ডাল থেকে ও ডালে উড়ে উড়ে গিয়ে ক্রমশ উপরে গিয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেল। ‘পিউঁয়ু, পিউঁয়ু, ডাকতে ডাকতেও আর পাখিটি চোখের সীমানায় এলো না। কোথায় যেন পাতার আড়ালে হারিয়ে গেল!
একদিন সকালে আমার বন্ধুকে ফোন করে এ কথা সে কথা জিগ্যেস করার পর পিউঁয়ুর কুশল জানতে চাইলে বন্ধুটি কিছু সময় নীরব থেকে এই গল্পটি বলতেই আমি কত কিছু যে ভাবতে লাগলাম। আমার বন্ধুটির না বলা কথা পিউঁয়ু জানতো। পিউঁয়ুই আমার এই বন্ধুটির সব দুঃখের ভাগীদার হতে পেরেছিল। এই পাখিটিই ছিল আমার বন্ধুর দুঃখ ভুলিয়ে দেওয়ার অবলম্বন। গভীর এক মায়ায় ও বন্ধুটির আশ্রয়ের ছায়ায় পাখিটি চঞ্চলতায় ভরিয়ে রাখতো পরস্পরের প্রতিটি প্রহর। আমি জানতাম আমার বন্ধুটি ভালোবাসতে চেয়েছিল। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খুঁজে পেতে চেয়েছিল এক টুকরো ভালোবাসার কাঁধ। আহা, সেই পাখিটিই ছিল শেষ পর্যন্ত আমার বন্ধুটির প্রাণের গভীর গোপন চাওয়া-পাওয়ার সাক্ষী ও অবলম্বন। বন্ধুটির সব দুঃখ বেদনা যেন আমাতেই এসে আশ্রয় করলো। সার্বক্ষণিকভাবে আমার প্রাণে এসে বাসা বাঁধলো এক ধরনের দুঃখ জাগানিয়া অনুভূতি।
এর দুদিন পরের সকালে আমার বন্ধুটি ফোন করে জানালো -তার পাখিটি ফিরে এসেছে! খুশিতে আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। মানুষ যখন একবার মুখ ফেরালে আর ফেরে না, সেখানে একটি ছোট্ট পাখি তার ভালোবাসার আশ্রয়ের কাছে ফিরে এসেছে! এই কবিতাটিতে আমি আমার আড়ালে বন্ধুটির সেই গল্পটিই বলেতে চেয়েছি। বলতে গিয়ে কিছু কিছু ঈঙ্গিত হয়তো লেখাটিতে আছে, বিমূর্ত ছবিতে যেমন রঙের প্রলেপে লুকিয়ে থাকে অব্যক্ত গল্পের ভাঁজ।
আমার লেখা হলেও কবিতাটি লেখার সময় আমি ছিলাম আমার বন্ধুর মতো অপ্রকাশিত সত্তার এক প্রতিচ্ছবি। জানো বাবু, পাখিটি এখনো পরম বন্ধু হয়ে আমার সেই মায়াময় মানুষটির কাছেই আছে।
আজকের সকালটি তুমি পরম আনন্দে ভরিয়ে দিলে বাবু। আজ সকালের এই আনন্দস্রোত আমার হৃদয়ে বহমান থাকবে আজীবন! তোমাকে অনেক ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা।