
“আপনার শরীর কেমন?”- কথাটার অর্থ আপনি অতিশয় দুর্বল বা একসময় অসুস্থ ছিলেন অথবা এখন অসুস্থ বা আপনাকে রোগে ধরেছে; এটা প্রশ্নকর্তা জানেন বলেই এমন প্রশ্ন করেছেন। অপরদিকে সুস্থ ব্যক্তিকে মানুষ জিজ্ঞেস করে- “কেমন আছেন?”; সেখানে মন বা শরীর শব্দটা অনুপস্থিত।
কিন্তু আপনি দিব্যি সুস্থ, অতিশয় বৃদ্ধ নন; অথচ কেউ আপনাকে জিজ্ঞেস করছে- “আপনার শরীর কেমন?”; তখন ভুরু কুঁচকিয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। কারন উত্তরে “ভালো আছি” বলা মানে তার প্রশ্নটাকে জায়েজ করা। এটা আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়। কারনটা বলতেই আজকের আলোচনা। তাই গতবার দেশে যাওয়ার আগে ঠিক করেছিলাম এ ধরণের প্রশ্ন শুনলে উল্টা জিজ্ঞেস করবো- “আপনার শরীর এখন কেমন?”; অর্থাৎ এক্সট্রা ‘এখন’ শব্দ যোগ করবো যাতে প্রশ্নকর্তা দ্বিতীয়বার ভেবে দেখে। করেছিলামও তাই, তবে প্রশ্নকর্তাকে বার্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছিলাম।
.
জানুয়ারি ২০১২, সবে দুই মাস আগে কানাডা এসেছি। আমি গরিব মানুষ, গিন্নির গয়না বিক্রি করে সামান্য পয়সা নিয়ে এসেছিলাম তিন মাস কোনভাবে চলার মতো। চাকরির জন্য বাঙালি সিভি দিয়ে কাজ হচ্ছিল না; অর্থাৎ জন্মতারিখ, বিবাহিত না অবিবাহিত, বাপ কী করে, শিয়া না সুন্নি; এসব তথ্য দেয়া রেজিউমি এদেশে অখাদ্য আর অযোগ্যতারই দৃষ্টান্ত। ব্যাপারটা তখনও ঠাহর করতে পারিনি।
মানুষের সাথে মিশতাম না। নিজ বিবেচনায় একটা প্রাইভেট কলেজে [সেখান থেকে পাস করার দুই বছরের মাথায় কলেজে লালবাত্তি জ্বলে গিয়েছিল] মেডিক্যাল ল্যাব টেকনিশিয়ান কোর্স এ ভর্তি হয়েছিলাম লুকিয়ে। কারন আমার ডাক্তার ভাই শুনলে কষ্ট পাবে। মানুষের রক্ত সংগ্রহ করা, আর কদাচিৎ ইসিজি করা। ভর্তির উদ্দেশ্য স্টুডেন্ট লোন নিয়ে কিছু নগদ টাকা হাতে পাওয়া। বছরখানেক সংসার কোনমতে হয়তো চলে যাবে। যদিও ঐ টাকা পরে ফেরত দিতে হবে সরকারকে। নিজে বাঁচলে পরে টাকার নাম..।
যাই হোক, কলেজে ভর্তির আগে কিছু মেডিক্যাল টেস্ট করা বাধ্যতামূলক। এর মধ্যে একটা ছিল যক্ষ্মা টেস্ট। আমার হাতের বাহুর চামড়া ফুটা করে TB antigen ঢুকিয়ে দিল ডাক্তারের এসিস্ট্যান্ট। তারপর কলম দিয়ে গোল করে দিলো জায়গাটা। দুদিন পর যখন দেখা করতে গেলাম, ভদ্রলোক খুব কনফিউজড, কারন রেজাল্ট পিজিটিভ না নেগিটিভ, উনি সেটা বুঝতে পারছিলেন না। কারন চামড়া তেমন ফুলে উঠেনি। ক্রিকেট খেলার মতো “বেনিফিট অব ডাউট” এর জয় হলো। পজিটিভ রিপোর্ট দিয়ে দিলো। এক্সরে করা হলো; লাং সুস্থ, কাশি বা দুর্বলতা, ওজন হারানো; কোনো লক্ষণ নাই। আমাকে বানিয়ে দিলো যক্ষ্মার রুগী।
ক্লাসের ইন্সট্রাক্টর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মেডিক্যাল টেস্ট এ তোমাদের কতজনের যক্ষ্মার রিপোর্ট পজিটিভ? আমরা একে একে দ্বীধাগ্রস্তভাবে ছয়জন দাঁড়ালাম। একজন ফিলিপিনো, একজন আফগান, আমি বাঙালি, একজন পাকিস্তানী আর দুজন সৌদি। অর্থাৎ সব এশিয়ানগুলো।
স্যার হেসে ফেলে বললেন, অদ্ভুত ব্যাপার! এদেশের অথরিটি হয়তো সামান্য সন্দেহ থাকলেও বেশি সাবধানতার কারণে পজিটিভ রেজাল্ট দেয়!
ব্যাস, যা হবার হয়ে গেলো।
আমার ঠিকানায় মিনিস্ট্রি অব হেলথ থেকে যক্ষ্মার ওষুধ পাঠিয়ে দিতে লাগলো ফ্রি। ফোন করে জিজ্ঞেস করে ঠিকমতো খাচ্ছি কি না। স্বাভাবিকভাবেই শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে প্রথম খবর পৌঁছে গেলো। আমার সাথে ফোনে কথা হলেই শুরুটা হয় এরকম উদ্বিগ্নভাবে, “রিপন, তোমার শরীর কেমন!?”। চার ভাইয়ের একমাত্র আদরের বোনের জামাই এর জীবন সংশয়। এমনিতেই কম খাই (?), তার ওপর যক্ষ্মা। ঘাটের মরা জামাই নিয়ে তাদের ঘুম হারাম। কয়েকবছর পরও জিজ্ঞেস করে, তোমার অসুখের কী অবস্থা এখন?
– কোন অসুখ?
– ঐ যে, আরে.. সেই অসুখ?
– কোনটা?
– সেই ঐ যে…
কিভাবে যেন আমার মায়ের কানেও গেলো। আম্মা কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করলো- “বাপ রে, শুনলাম তোর যক্ষ্মা হইছে? এখন শরীর কেমন?”
.
খবর ছড়িয়ে পড়লো দিক হতে দিগন্তে। আমি সোফায় বসলে সে সোফায় আর কেউ বসে না। লোকজন হ্যান্ডশেক, ঈদ এ কোলাকুলি করে সাবধানে। যেমন ঈদগাহে আওয়ামী-বিএনপি নেতার দেখা হয়ে গেলে যেভাবে তিন ফুট ডিসটেন্স থেকে হাওয়ায় কোলাকুলি করে..
গত বৎসর বাংলাদেশ গিয়েছিলাম।
সেই এগারো বছর আগের যক্ষ্মার ধক এখনো চলছে। এখনো “তোমার শরীর কেমন?” প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাই। দিয়েও যাবো আমরন; কারন বয়স হয়ে যাচ্ছে, অনেক রোগবালাই ওত পেতে বসে আছে! বহু আগে চাচা-মামা হয়েছি।
নানা দাদাও হবো ইনশাআল্লাহ!
আর হ্যাঁ, আপনাদের সবার শরীর কেমন?
ভালো থাকবেন সবাই।