1 C
Toronto
সোমবার, মার্চ ১৭, ২০২৫

কানাডার শীত রাত

কানাডার শীত রাত
শীতের রাত সেই যে শুরু হয় বিকাল সাড়ে চারটায় আর শেষ হওয়ার নাম নাই

শীতের রাত সেই যে শুরু হয় বিকাল সাড়ে চারটায়.. আর শেষ হওয়ার নাম নাই..

ওদিকে গরমকালে অন্ধকার নামে সন্ধ্যা সোয়া নয়টায়। বিছানায় শুতে না শুতেই সকাল। আরাম করে যে একটু ঘুমাবো, রাতের খাবারের পরে আরেকদফা একটু ফ্রিজ খুলবো; সে উপায় নাই। আচ্ছা, তারমানে গরমের রাতে মোট সময় হলো- [আঙ্গুল গুনে দেখতে থাকি] সোয়া দশ, সোয়া এগারো, সোয়া বারো, সোয়া তেরো.. [থুক্কু] সোয়া এক, সোয়া দুই, সোয়া তিন, সোয়া চার, সোয়া পাঁচ, সোয়া ছয়; মোটমাট নয় ঘন্টা। আর শীতকালের রাত হলো- ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮.. ষোলো ঘন্টার! [সরি পাঠকগনণ, আমি অংকে খুব কাঁচা আর স্বভাবে খুবই স্লো]

- Advertisement -

রাতে খিদে তো আর এমনি এমনি লাগে না!
.
গত সপ্তাহে যে কি এক দিন গেলো! ২২ ডিসেম্বর রাত এতই বড় ছিল ভাই রে ভাই.. শেষই হচ্ছিলো না। প্রতিটা মিনিট মনে হচ্ছিলো যেন এক একটা যুগ! সতেরো ঘন্টার রাত কিভাবে যে কাটাচ্ছিলাম..

মানুষ যে কেন রাত ভয় পায় খোদা জানে। আমার ভয় দিন। দিন শুরু হলেই দাঁত মাজো, অফিসে যাও, বাজার করো, ময়লা ফেলো, গাছে পানি দাও, রান্না করো, বাসন মাজো, কাপড় ধোও, ঘর ঝাড়ু দাও..

রাতে দায়িত্ব কমে আসে।

এখন বাজে সাড়ে এগারোটা।

আজ কেন জানি সবাই আগে আগে ঘুমাতে গেছে। আমি একটু আগে সব কয়টা ঘরের আশপাশ পায়চারি করে নিশ্চিত হয়ে আসলাম। গিন্নির কম্বলটাও গায়ের সাথে লেপ্টানো; জেগে থাকলে আসমানে তুলে ধরা মোবাইলের কারণে বিছানাটা তাবু আকারের হয়ে থাকতো।

সেই সাড়ে নয়টায় খাইসিলাম দুইটা রুটি, এক বাটি ভেড়ার মাংস দিয়ে ছোলার ডাল আর চা। ..সাড়ে নয়, সাড়ে দশ, সাড়ে এগারো; তিন ঘন্টা না খাওয়া! পেট বেশিক্ষন ফাঁকা রাখলে আলসার মরবো তো! নাড়ি ফুটা হয়ে ব্লিডিং হয়ে মরা বুদ্ধিমানের কাজ না।

টিভির সামনে থেকে উঠে গিয়ে ডাইনিং এ রাখা গিন্নির হাতে বানানো রুটির বক্সটা খুললাম। রুটি কেনজানি নষ্ট হয় না। তিন-চারদিন আলগোসে ফ্রিজের বাইরে রাখা যায়। আটা আসলে মাখানো হয়েছিল বাচ্চাকাচ্চার পিজা বানানোর জন্য। অর্ধেকের বেশি বেঁচে যাওয়ায় সেগুলো দিয়ে গিন্নি রুটি বানিয়েছে। ইস্ট এর কারণে অনেকটা নান রুটি হয়ে গেছে; ফোলা আর নরম। গিন্নি বেলে ট্রে-তে রাখছিল, আর আমি তাওয়ায় ছ্যাঁকলাম। তাই রুটিগুলোয় আমার অধিকার ফিফটি ফিফটি।

রাতে যেহেতু ডাল একবার খাইসি, তাই এখন বাদ। সকালের খিচুড়ীর সাথেকার মাখানো ঝাল, আর দুপুরের মুরগির ঝোল থেকে একটা আলু আর মেরুদণ্ডের হাড় বাটিতে তুলে গরমে দিলাম। রুটি ঢুকালাম টোস্টারে। একসাথে থালে গরমে দিলে ঝোলে মাখামাখি হয়ে বিতিকিচ্ছিরি কান্ড হবে। ফ্রিজে আরেক বাটির তলায় অল্প একটু ডিম ফেটানো ছিল। গিন্নি ওটাতে টুনা কাবাব মাখিয়ে ভেজেছিল। নষ্ট না করে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, লবন মাখিয়ে রিসাইকেল করে ভেজে ফেললাম। সোয়াব হবে। কিছু বিস্কুটের গুঁড়া আর কাবাবের ভাঙা ক্ষুদ্রাংশ মিশে হলো সেই স্বাদ!

তিন রুটি ঝোলে চুবিয়ে সাবাড় করতে লাগলাম। তাড়াহুড়ার কিছু নাই, রাত অনেক বড়। চেটেপুটে খেয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে এক কাপ দুধ চা হাতে খবর দেখতে থাকি নিবিষ্ট মনে।
মনটা খুব উদাস হয়ে গেল।

দেশে থাকতে কত ঝাল তরকারি খেতাম। স্বাদ আসলে ঝালে। মশলা না দিয়ে এক গাদা ঝাল আর লবন-তেল দিয়ে যেকোনো জিনিস রান্না করলেও তুখোড় লাগবে। গত বছর ঠিক এ সময়ে বাংলাদেশ ছিলাম। প্রতি সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া শহর ঘুরে হাবিজাবি খেতাম। কি স্বর্গীয় অনুভূতি! আর আম্মা ডাইনিং টেবিলে গালে হাত দিয়ে বসে শুধু চিন্তা করতো- ছেলেটাকে আর কী কী খাওয়ানো যায়?

পেটের দায় না থাকলে কবে দেশে ফুটতাম!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এঁটো থালাবাসন রান্না ঘরের সিংকে রেখে আবার ফ্রিজ খুলে দই এর কৌটায় গিন্নির বানানো ফুচকার ঝোল, বক্সে রাখা আলু-ডাবলির ভর্তা, শসা, ধোনে পাতা কুচি, অর্ধেকটা সেদ্ধ ডিম বের করে ডাইনিং টেবিলে রাখতেই আওয়াজ পেলাম কে যেন উপরের বাথরুমের দরজা খট করে বন্ধ করলো।

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে চুপচাপ বসে অপেক্ষায় থাকি।
ফ্ল্যাশ হবার আওয়াজ শেষ হতেই বেরিয়ে আবার খট করে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ার কটকট আওয়াজ পেলাম। যাক বাবা! ফুচকা আছেই মাত্র আটটা; ভাগ বসালে আর কী খাবো?

ফুচকাগুলো প্লেটে রেখে তর্জনী দিয়ে পাখির মতো ঠোকর মেরে উপরিভাগ ছিদ্র করে ভেতরে আলু-ডাবলি ভর্তা ভরতে থাকি। কিছুটা ফাঁকা রাখলাম; এখনো ধনেপাতা, শসা আর সেদ্ধ ডিমের কুচি ঢুকবে। আর উপরে ছিটিয়ে দিবো সামান্য ঝাল চানাচুর আর প্রচুর থাই ঝাল কাঁচামরিচ কুচি। শেষে চাট-মসলা দেয়া তেঁতুল পানি!

ফুচকাগুলো কাল বিকেলে গিন্নি খুঁজে না পেয়ে চেহারাটা কেমন বানাবে ভাবতেই আমার মুখে একটা বাঁকা শয়তানি হাসি খেলে গেলো। আহা ব্যাচারী! তবে ফুচকা ছুঁয়ে প্রমিজ করলাম, কালই গিন্নি কে আবার এক প্যাকেট ফুচকা কিনে দিবো। অন্তত পঞ্চাশটা তো থাকেই এক প্যাকেটে। সাথে তেঁতুল আর যা যা লাগে সব কিনে দিবো।

দইয়ের কৌটা খুলতেই লালচে-খয়েরি তেঁতুল পানিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো ভাজা জিরা, শুকনো মরিচের গুঁড়া। বিটলবণ মিশে তুখোড় ফ্লেভার ছুটছে। ফুচকা আবিষ্কারক কে নোবেল প্রাইজ দেওয়া উচিত। এরকম আর্ট আর বৈচিত্র দুনিয়ার আর কোনো খাবারে নাই। চিন্তা ক্ষমতা কোন লেবেলে পৌঁছালে এরকম আইডিয়ার খাবার আবিষ্কার করা যায়?
বাঙালি ঐতিহ্যের অন্যতম আবিষ্কার এই কালজয়ী ওয়াটারপ্রুফ ফুচকা।

তেঁতুল ঝোলে টইটম্বুর আস্ত একটা ফুচকা মুখে দিতেই মচমচ করে মাটির কলসীর মতো ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো মুখবিবরে। গলগল করে বের হয়ে আসা টক-ঝাল-মিষ্টি তেঁতুলের রস মুখের আনাচে-কানাচে তে লেপ্টে যেতেই আরেক চমক এসে হাজির; শসা-চানাচুরের কুচি দাঁতের তলায় পড়তে না পড়তেই আবার হাজির হলো মাখনের মতো আলু-ডাবলি ভর্তার ছোঁয়া। তিনটা ঘটনা ঘটতে সময় নিলো দেড় সেকেন্ডেরও কম! এ তিন স্তরের কুচকাওয়াজ মহড়া চলল বেশ কিছুক্ষন! তেঁতুলের স্বাদে মুখে জমা হতে লাগলো লিটারখানেক লালা..

আনন্দে চোখ বন্ধ হয়ে আসলো।

এ না হলে বাঙালি খাবার!

এ পর্ব শেষ হতেই ঘড়িতে তখন বাজে রাত প্রায় পৌনে একটা। তাই দেরি না করে তিনটা গোলাপজামুন মিষ্টি দুচামচ ঝোলসহ মাইক্রোতে গরম করে সাথে হাঁসের পালকের মতো মোলায়েম এক পিস রেড ভেলভেট কেক নিয়ে, পা তুলে কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে ধীরে-সুস্থে পিরিচে চামচ চালাতে থাকি।

চামচে চাপও দিতে হচ্ছে না, চামচের ভারেই কেটে যাচ্ছে কেক..

ওদিকে ইলেক্ট্রিক কেতলি খট করে আওয়াজ তুলে জানান দিলো- তোমার পানি গরম; রেডি হে খাদ্য মন্ত্রী!

[বাংলাদেশ গেলে আমার বড় ভাবি আমাকে এ নামেই ডাকে..]

আমি উঠে আধা মগ টগবগে ফুটানো পানির মধ্যে আরও আধা মগ দুধ ঢেলে নিয়ে কিচেন কেবিনেটের উপরের তাকের শেষ প্রান্তে লুকিয়ে রাখা কৌটা হাতড়ে নামিয়ে সেখান থেকে তিন চামচ হট চকলেট গুঁড়া মিশিয়ে সাবধানে হাল্কা করে গুলিয়ে নিতে থাকি।
অল্প গোলালে উপরিভাগে ফেনার সাথে সুমিষ্ট কিছু বখে যাওয়া ডানপিটে চকলেটের দলা ভাসতে ভাসতে জলকেলী করতে থাকে। দুষ্টুগুলোকে জিহবা দিয়ে মুখের তালুতে পিষে নিয়ে, শাস্তি দিতে দিতে চুমুক মারতে থাকি..

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles