
সালমাঃ তুমি তো নপুংসক।
ফরিদাঃ হা হা হা… হা হা হা… আমাকে কেউ হাফ লেডিস বলে ডাকে, কেউ বলে মাইগ্যা আবার কেউ ডাকে হিজড়া।
ইচ্ছে করলে আপনি আমাকে হিজড়া বলে ডাকতে পারেন। আমি গালি হিসাবে নেব না।…হি-জ-ড়া… হাঁ হাঁ হাঁ…
সালমাঃ এতো হাসার কি হলো
ফরিদাঃ হাসবো না? মানুষদের মধ্যে যেমন পুরুষ মানুষ আর মেয়ে মানুষ। তেমনি আমরা হলাম না পুরুষ না নারী ঐযে বললেন নপুংসক ঠিক তাই।
হয়তো দেহটা নারীর মত নয় কিন্তু মনটা তেমন। আবার উল্টোটাও হতে পারে।
চলনে পুরুষ বলনে নারী।
জন্মের সময় এক রকম – বড় হয়ে অন্যরকম।
আপনাদের মত চিরকাল হয় পুরুষ, না হয় নারী হয়ে থাকতে পারলাম না আমরা।
দেন না আমাদের একটু অধিকার।
করেন না আমাদের জন্য একটু ফাইট।
আপনার নিজের অধিকারের জন্য যেমন ফাইট করেন আমাদের জন্য একটু বলে দেখন না, কিছু করতে পারেন কিনা।
জানেন, ছোটবেলায় আমি লুঙ্গি পরতাম। ছেলেদের স্কুলে যেতাম। কিন্তু একটু বড় হতেই আমার মেয়েদের সাথে খেলতে ভাল লাগত। আমার সাজতে ভাল লাগতো। একদিন বড় বোনের লিপস্টিক দিয়ে ঠোট লাল করে ফেলেছিলাম। তাতে রেগে গিয়ে আমার বোন আমাকে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মেরেছিল। সে্টাই জীবনে প্রথম থাপ্পড় খাওয়া। কান্না শুনে রান্না ঘর থেকে মা দৌড়ে এসে আমাকে কোলে নিয়ে বোঝাতে লাগলো।
– ছেলেরা ঠোটে লিপস্টিক দেয় না বাবা।
– তুমি আর কখনো তোমার আপার চুলের ক্লিপ মাথায় দিবে না।
– কপালে টিপ দিবে না। ওগুলো মেয়েদের সাজ।
মা বললে কী হবে, ছোট বেলা থেকেই আমার ওসব ভালো লাগতো। বড় হবার পর আরো বেশি মেয়েদের মত হয়ে গেলাম। শরীরের মধ্যেও পরিবর্তন এলো। চলাফেরা দেখে মানুষ বুঝতে শুরু করলো আমি ছেলে হয়ে জন্মালেও সম্পূর্ণ ছেলে না। আমি হিজড়া হয়ে যাচ্ছি।
(একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে) আমার অন্তর গড়ন আর বহির গড়ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশ পেতে লাগল। আমার দেহ মনের চাহিদার সাথে বৈরিতা শুরু করল।
বলেন সে এটা কি আমার দোষ। আল্লাহ আমাকে এমন করে দিতে লাগল অথচ আমার করার কিছু থাকল না। পরিবারের আপনজনের কাছে থেকে বিতাড়িত হয়ে ঘর ছাড়লাম। যে সমাজে এখন বসবাস করি সে সমাজের অচ্ছুৎ হবার কষ্টও কম না। লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হবার কষ্টে আমাদের মত আর কেউ নেই।
লোকে যেন বুঝতে না পারে আমি হিজরা তার জন্য ছোটবেলায় ঘরের মধ্যে আমাকে বন্দি করে রাখতো। শেষের দিকে শিকল দিয়ে বেধে রাখতো। বড় ভাই এসে পেটাত। বাবা সারাদিন বকাঝকা করত।
একদিন বড় চাচা আর তার ছেলে মিলে বুদ্ধি করল আমাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবে। আব্বা নীরব থাকলো। হাঁ না কিছুই বলল না। আমি হিজড়া এ কথা জানাজানি হয়ে গেলে আমার বোনদের বিয়ে হবে না। আব্বাকে সবাই বলবে হিজড়ার বাবা। তাই তিনিও আপত্তি করলেন না।
ভাগ্য ভাল আম্মা কথাটা শুনে ফেলেন। সুযোগ বুঝে তিনি তালা খুলে দিয়ে বলেছিলেন;
যা- যা – যেদিকে দুচোখ যায়, চলে যা। ভুলেও এই গ্রামে ফিরে আসবি না। তুই ফিরে এলে আমি আত্মহত্যা করবো।
মুক্তি পেয়ে আমি ভাগতে লাগলাম। গ্রাম থেকে ছোট শহর, তারপর এই ঢাকা শহরে এক গুরু মায়ের আশ্রয় পেয়ে বেঁচে গেলাম। এমনও সময় গেছে দুই তিনদিন না খেয়ে থেকেছি। কেউ কোন কাজ দিত না। কারো বাসায় ঢুকতে দিত না। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় রাস্তার ছেলে মেয়েরা বলত হিজড়া হিজড়া। ইট পাথর ছুঁড়ে মারত। একদিন একবেলা ভাতের লোভ দেখিয়ে আমাকে ট্রাকের তুলে নিয়ে সারারাত খারাপ কাজ করেছিল। একবার না – অনেকবার আমার সাথে খারাপ কাজ করেছে ওরা।
আমি যদি আপনার মত যা খুশি তাই করতে পারতাম। যদি চুলে লাল ফিতা দিয়ে বেণি করতে পারতাম, ঠোটে লিপস্টিক দিয়ে সাজতে পারতাম। আপনার মত বোরকা পরে সমাজে টিকে থাকতে পারতাম, তাহলে দুবেলা খাবারের জন্য আমাকে এখন চাঁদাবাজি ধান্দাবাজী করতে হত না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন বাচ্চা হলে নাচ গান করে আহার যোগাড় করতে হতো না।
মাঝে মাঝে মনে হতো ঈদের দিনে মায়ের হাতের দুধ সেমাই খেয়ে আসি। কিন্তু আমার ইচ্ছাতে কিছু হয় না। আপনার কপাল কত ভালো দেখেন। মনের মত শাড়ি পরেন আবার ইচ্ছে মত বোরখা দিয়ে সেই পছন্দের শাড়ি ঢেকে রাখেন।
(চিৎকার) আমি নিজ থেকে হিজড়া হই নি। আমাকে কেউ হিজড়া বানিয়েছে……
(ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে বলা হবে);
২০১৫ সালের ৩০ মার্চ ঢাকার বেগুনবাড়িতে যখন দুজন জঙ্গি, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যা করে দৌড়ে পালাচ্ছিল, তখন সাধারণ মানুষ ভয়ে সেই খুনিদের না ধরে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। অথচ সেদিন লাবণ্য নামের একজন হিজরা একাই দুজন জঙ্গিকে ধরে ফেলেছিল। জঙ্গিরা বাঁচার জন্য লাবণ্যের হাতে চাপাতি দিয়ে কোপ দিয়েও ছুটতে পারে নাই। পরবর্তীতে তাদের দুজনকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়। আমাদের আজকের নাটক সেই তৃতীয় লিঙ্গের লাবণ্যকে উৎসর্গ করা হলো।
উপরের কথা শেষ হতেই দর্শকদের মাঝে বসে থাকা কিছু মানুষ হঠাৎ ধর… ধর…. ধর একটা চিৎকার করে মঞ্চের দিকে দৌড়ে আবার আড়াল হয়ে যাবে।
সালমা এবং ফরিদা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকবে। পাশাপাশি কিন্তু ওদের চোখাচোখি হবে না- দুজনেই দেখতে থাকবে কোথা থেকে এই আওয়াজ আসছে। হঠাৎ মঞ্চে একজন লোক এসে হাঁপাতে থাকবে। তার হাতে একটি রক্তমাখা চাপাতি। ওকে আসতে দেখে ফরিদা হাত উঁচু করে গতিরোধ করে দাঁড়াবে। পেছন থেকে সালমা বলবে,
সালমাঃ ফরিদা ফরিদা সরে এসো ওর হাতে চাপাতি আছে।
ফরিদা সালমার বারণ শুনবে না। আগন্তুক যেদিক দিয়ে পালাবার জন্য মোর ঘুরবে সেদিকেই ফরিদা হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়বে। এরকম দু’একবার করার পর সালমা পেছন থেকে এসে ফরিদার আঁচল টেনে ধরবে। সেই অবস্থায় ফরিদা পিছু ফিরে তাকালে ওদের চোখে চোখে চাওয়া সম্পূর্ণ হবে। বুকে অতিরিক্ত সাহস পেয়ে ফরিদ তখন বলবে;
ফরিদাঃ তুই কে? তোর হাতে রক্ত কেন?
আগন্তুক: আমি নাস্তিককে হত্যা করে এসেছি।
ফরিদাঃ কী? তুই মানুষ খুন করেছিস?
আগন্তুক: মানুষ না নাস্তিককে খুন করেছি। খুন করার হুকুম আছে। এই হিজড়া ছাড় আমাকে।
ফরিদাঃ ওহ তাই। নাস্তিককে খুন করার হুকুম আছে তাই না? ওরে আমার খুনি। তবে তো খুনিকে পাকড়াও করার হুকুম আছে। বেটা তোর আজ রক্ষা নেই।
এই বলে ফরিদা আগন্তুকের চারিপাশে হিজড়ারা যে বিশেষ পদ্ধতিতে তালি দিতে থাকে চোখে মুখে তীব্র ক্রোধ নিয়ে সেভাবে ঘুরে ঘুরে তালি দিতে থাকবে।
ফরিদাঃ ‘আমার মাথায় লম্বা কেশ, খুনিরে খুনি তোর সময় শেষ’। ‘আমার মাথায় লম্বা কেশ, খুনিরে খুনি তোর সময় শেষ’। ‘আমার মাথায় লম্বা কেশ, খুনিরে খুনি তোর সময় শেষ’।
এক পর্যায়ে সালমাও এগিয়ে এসে আগন্তুককে কেন্দ্র করে ফরিদার সাথে সাথে ঘুরতে থাকবে এবং সেও মেয়েদের স্বাভাবিক ভঙ্গী ও রিদমে তালি দিতে থাকবে। এমন সময় মঞ্চের পেছন থেকে পুলিশের বাঁশি শোনা যাবে। ধীরে ধীরে মঞ্চের লাইট কমে যাবে। পর্দা পড়বে।
সমাপ্তি
নাটক: ইচ্ছাপূরণ
নাট্য দল: ইতিহাস দেশ সমাজ
অভিনয় শিল্পী: অরুণা হায়দার, রোজিনা করিম কনক ও রেজা-ই রহিম স্বপন
আবহ সঙ্গীত: খালেদ মোহাম্মদ আলী
শব্দ ও আলোক নির্দেশক: লিটন কাজী ও সাদাকাত হোসেন
রচনা ও নির্দেশন: আকতার হোসেন