
মায়ের কবর, চট্টগ্রামে। স্টেশান রোডে বিশাল গণ কবরস্থানে। আমি কেন জানি আত্মজ কেউ মারা গেলে শেষকৃত্যতে যাইনা। ইচ্ছে করে টাল বাহানা করে দেরী করি। ১৯৮৩ সালে বাবার মৃত্যুর সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। বাবার মৃত্যুপূর্ব তীব্র ইচ্ছায় সদ্য বিয়ে করেছি। সকালে খবর পেয়ে গড়িমসি করে দুপুরের ট্রেন ধরে সন্ধ্যার পর চট্টগ্রাম পৌঁছালাম। ততক্ষণে বাবাকে সমাধিস্ত করা হয়ে গেছে। মায়ের মৃত্যুর সময় ও টরন্টো থেকে চলে আসতে পারতাম! দেরী করেছি।কারণ মায়ের শেষ সাফারিং চোখের সামনে দেখার সাহস নিজের মধ্যে তৈরী করতে পারিনি। নিজের সঙ্গে শপথ করে ছিলাম যত বার চট্টগ্রাম আসবো বাস কিংবা ট্রেনে এসে নামলে বাড়ি যাওয়ার আগে বাবার কবরে যাবো।
বছরের পর বছর করেছিলামও তাই। তাসে মুশলধারা বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা কুয়াশায় ঢাকা মধ্যরাতে,যখনি নেমেছি চট্টগ্রামে তাই করেছি। এরপর একবার ঘটলো অঘটন সেইবার খুব ভোরে অন্ধকার যায়নি তখনো কবরস্থানে ঢুকে চুপচাপ বসে আছি বাবার কবরের সামনে হঠাৎ এসে ঘিরে ধরলো একদল লোক সাথে এক গাঁজাখোর টাইপের পুলিশ কনেস্টেবল ও রয়েছে। পরে জেনেছি এরা কাফন চোরা গ্যাং। তাজা কবরের মাটি সরিয়ে সাদা কাপড় টেনে খুলে নিয়ে জমিয়ে বিক্রী করে। ওরাই আমাকে চোর বলে উঠলো। চুরির মাল কবরে লুকতে এই ভোরে কবরের কাছে উপুড় হয়ে আছি। আমার কনো কথাই শুনলো না। টেনে হেঁচড়ে যা ছিলো আমার সবই নিয়ে নিলো। তখন বোতাম টেপা নকিয়া ফোন ছিলো,টাইমেক্স ঘড়ি ছিলো,মানি ব্যাগতো নিলোই গা থেকে জামা টি শার্ট জিন্স প্যান্ট পায়ের ক্যাটস। তাদের ভদ্রতা জ্ঞান দেখে ভালো লাগলো।
একজন শুটকা মতন আমার প্যান্ট নিজে পরে নিয়ে তার লুঙ্গি আমাকে পরতে দিয়ে গিয়ে ছিলো। সদ্য উদ্ভাসিত ভোরের আলোয় আমি খালি গায়ে,খালি পায়ে রিক্সা নিয়ে বাড়ি ফিরে ছিলাম। মা ভীষণ রেগে বলেছিলেন – একি তোমার ঢং! কবর দেয়ার দিন এলেনা আর তারপর থেকে নাটক করে যাচ্ছো। কেন এসব করছো? আমার কোনো উত্তর জানা নেই। তবে আমি থামলাম না। এরপরও যখনি এসেছি আগে কবরে গিয়েছি। তবে থামতে হলো সেদিন। যে দুপুরে ঢাকা থেকে সকালে ছাড়া ট্রেনে দুপুরে চট্টগ্রামে এসে পৌঁছলাম সাথে আমার গ্রীনহেরাল্ড স্কুলে পঞ্চম ক্লশে পড়া একমাত্র কন্যা সন্তান অগ্নিলা। কবরস্থানের প্রধাণ গেইটে ঢুকতে যেতেই বাঁধা। টুপি পরা কিছু যুবক কবরীয় মাস্তান ঘিরে ধরলো। মহিলা নিয়ে কবরস্থানে ঢোকা নিষেধ। বাইরে দেয়ালে বড় করে এনামেল পেইন্ট দিয়ে লেখাও ছিলো তখন। অনেক বুঝিয়ে বল্লম ওতো মহিলা এখনো হয়নি।
ছোট মেয়ে তার দাদার কবর দেখবে। তাদের এক কথা ছোট হোক বড় হোক মহিলা প্রবেশ নিষেধ! কি আর করি ভাবলাম দুপুরের এই হট্টোগোলের ফুটপাথে একধারে অগ্নিলাকে দাঁড়া করিয়ে বাবার কবর থেকে ঘুরে আসি। আচমকা বাবা মগজে উদয় হলেন,চোখে স্পষ্ট ওনাকে দেখতে পাচ্ছি। ঠিক জীবীতকালে যেমন আমার ওপর রেগে গেলে বলতেন – খচ্চরের বাচ্চা! মাথায় কি ঘিলু কিচ্ছু নেই? আমিতো নাই! নিজের ফুটফুটে মেয়েকে এই নরকীয় ফুটপাথে দাঁড়া করিয়ে গেলে ফিরে এসে দেখবে সেও নাই হয়ে গেছে। আজ থেকে আমার কবরে এসব নাটক করতে আর আসবিনা এসব ঢং করতে! সেই থেকে যাওয়া হলো আমার বন্ধ। এবার মাও গেলেন। আমার বোনের ছেলে মাকে দুই হাতে তুলে নিয়ে কবরে নামিয়েছে। আমি থকলে একাজ আমাকেই করতে হতো। মা ২৫শে ডিসেম্বর মারা গেলেন।
আমি ১৮ জানুয়ারী ঢকায় এসে নামলাম। মা যেমন বলে ছিলেন তীব্রভাবে মনে করো আমাকে আমি আছি তোমরই মধ্যে,তোমার মগজে। টরন্টোতে থাকতে গাড়ি স্ট্রাত দিতে,বিমানে উড়তে খাওয়া মুখে দিতে,ফুটপাথ পার হতে বলি। মনে মনে বলি আমি যতই পাপী হই তবু ওনারই সন্তান! ওনাকে শান্তি দেন। ক্ষমার অযোগ্য যদি কোনো পাপ তাঁর থাকে তা আমার একাউন্টে ট্রান্সফার করে দেন। তাঁর সারা জীবন আমরা তাকে শান্তি দিতে পারিনি।আমাদর নিয়ে অস্থর থকতেন। গোটা জীবন তার আমাদের নিয়েই চিন্তীত রেখেছি। এখন তাকে শান্তি দেন।
স্কারবোরো, কানাডা