কিছুক্ষণের মধ্যে রেকর্ডিং শুরু হবে। তনুকা টেবিলের ওপর এলিয়ে বসে আছে। কালো রঙ ওর সাথে যায় না। তবুও সে সাদা-রঙিন কিছু পরবে না। জামা কাপড়ের বেলায় ভীষণ একরোখা। তর্জনী দিয়ে টেবিলে টোকা দিতে দিতে কণ্ঠ গড়িয়ে বলল, অনেক তো করলাম তোর যষ্টিমধু। আর কতদিন এসব করতে হবে…
সিজান খুব সিরিয়াসলি স্ক্রিপ্ট দেখে যাচ্ছে। তনুকার দিকে না তাকিয়েই বলল, তোকে না কতবার বারণ করেছি ‘অনেক’ শব্দটি ব্যবহার করবি না।
‘অনেক’ বললে কী হয়?
অনেক এর মধ্যে দম্ভ থাকে। অহংকার থাকে। অনেক বই পড়েছি। অনেক দেশ ঘুরেছি। শুনলে মনে হয় দেই একটা কষে। কেউ কি বলতে পারে, কয়টাতে অনেক হয়?
তাহলে কী বলবো, ‘বেশ কিছু’!
সোজা হয়ে বস।
তনুকা সোজা হয়ে বসে। অন্য মেয়ে হলে এইটুকু সোজা হতে হতে চুলটাকেও কায়দা করে সোজা করে নিত। তনুকার কি সেদিকে খেয়াল থাকে। নিজে সোজা হয়েছে কিন্তু বেওয়ারিশ চুলগুলো ওর থেকে দশ হাত দূরে। বলল, আজ কী নিয়ে আলোচনা করবো। রেকর্ডিং হবে না লাইভ করছিস। আমি কিন্তু সন্ধ্যার দিকে একটু ব্যস্ত থাকবো।
এখন রেকর্ডিং হবে। অন-এয়ার সন্ধ্যায় সাতটায়।
কি বিষয় নিয়ে বলবো, তা তো বলবি?
আজ রবীন্দ্রনাথের ক্যামেলিয়া নিয়ে কথা বলবো।
ওএমজি! ক্যামেলিয়া। আমার দারুণ পছন্দের কবিতা। তোকে তো বলেছি, মা… থাক তুই তো আবার এককথা বারবার শুনতে পছন্দ করিস না।
কাঁচের ওপাশ থেকে আঙ্গুল গুনে, তিন – দুই – এক দেখাতেই শুরু হয়ে গেল রেকর্ডিং। মাত্র তিন মাসের মধ্যে ‘সিজান তনুকা যষ্টিমধু’ টকশো অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতিবার সিজান কিংবা তনুকা এমন কিছু তাক লাগানো কথা বলে ফেলে যা পরের সপ্তাহ পর্যন্ত শ্রোতাদের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। অথবা টক অব দ্যা চায়ের আড্ডা হয়ে যায় ওদের কথার কথা।
এবার মনোযোগ দেওয়া যাক ওদের হাই লাইটেড কথোপকথন।
সিজানের প্রশ্ন, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব’। আমি জানতে চাচ্ছি, সেই প্রেক্ষাপটে ক্যামেলিয়া কবিতাটির কোন অংশ আপনার কাছে মনে হয়েছে অনেক দূর যেতে পেরেছে?
কেন? সে তো কাব্যের মধ্যেই আছে। মনে নেই গুরু লিখেছেন, ‘ক্যামেলিয়া! সহজে বুঝি এর মন মেলে না’…। এর মানে কী দাঁড়াল? মন মিলল তো সব শেষ, মানে সমাপ্তি। না মেলা মন দিয়ে ভালোবাসা শুরু করতে হয়। আপনি কি কখনো এমন গল্প পড়েছেন যা শুরু হয়েছে সুখ বা শান্তি দিয়ে? আমি পড়ি নি। ‘হ্যাপি’ মানে হচ্ছে ‘এন্ড’। অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল। সবাই বুঝে গেল সুখ এলো তো গল্প ফুরালো। এই জন্যই বলে ‘হ্যাপি এন্ডিং’। কাজেই শুরু করতে হয়, শুরু না করে। কি! কিছু বুঝা গেল?
আপনি বলতে চাচ্ছেন যাকে বাহুডোরে বাঁধা যায় না সে-ই হচ্ছে ক্যামেলিয়া? তাহলে ভালবাসায় যে সাড়া দেয় না আমরা কি তাকে ক্যামেলিয়া বলে ডাকতে পারি?
তা যার যা খুশি ডাকবেন। এমনি করেই তো অনেকের নাম ‘দেবদাস’ হয়ে গেছে। যাকে ধরা যায় না সেও না হয় হয়ে যাক ‘ক্যামেলিয়া’। দেবদাস পার্বতীর বদলে দেবদাস ক্যামেলিয়া।
আচ্ছা শেষ করা যাক। মিস তনুকা, আজ কি দিয়ে শেষ করতে চাচ্ছেন?
আমার সবচেয়ে পছন্দ হলো শেষের লাইনগুলো। তবে লাইন বাই লাইন মনে নেই। না হলে শুনিয়ে দিতাম।
আমারও ইচ্ছে শেষের লাইনগুলো দিয়ে আজ শো শেষ করি। পুরো কবিতা আমার কাছে লেখা আছে। আজ না হয় ক্লোজিং স্টেটমেন্ট আমার মুখ দিয়েই যাক। আপত্তি নেই তো।
খুব ভালো হয়। আপনি তো বেশ ভাল আবৃত্তি করেন।
—–
‘তখনি চলে যেতেম, কিন্তু বাকি আছে একটি কাজ।
আর দিন-কয়েকেই ক্যামেলিয়া ফুটবে,
পাঠিয়ে দিয়ে তবে ছুটি।
সমস্ত দিন বন্দুক ঘাড়ে শিকারে ফিরি বনে জঙ্গলে,
সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে টবে দিই জল
আর দেখি কুঁড়ি এগোল কত দূর।
সময় হয়েছে আজ।
যে আনে আমার রান্নার কাঠ।
ডেকেছি সেই সাঁওতাল মেয়েটিকে।
তার হাত দিয়ে পাঠাব
শালপাতার পাত্রে।
তাঁবুর মধ্যে বসে তখন পড়ছি ডিটেকটিভ গল্প।
বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, “বাবু ডেকেছিস কেনে।”
বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া
সাঁওতাল মেয়ের কানে,
কালো গালের উপর আলো করেছে।
সে আবার জিগেস করলে, “ডেকেছিস কেনে।”
আমি বললেম, এইজন্যেই’।
নির্ধারিত ত্রিশ মিনিটের রেকর্ডিং শেষ হয়ে গেল। তনুকা চলে যাবে বলে উঠে দাঁড়ায়। দাড়িয়েই বলে, যাই রে।
এমন করে বলল যেন সে এতক্ষণ এখানে ছিলই না। অথবা ছিল কিন্তু যাই বলার পর আর নেই।
সিজান একটা এনভেলপ তুলে দিয়ে বললো, এই নে তোর খাম।
ঘাম না ঝড়িয়ে খাম, মন্দ না কি বলিস সিজান। আসি রে। এই বলেই তনুকা সুড়ুত।
চলে গেল বটে কিন্তু সিজানের কাছে মনে হচ্ছে তনুকার সবটাই রয়ে গেছে। সব না হলেও ওর মমতা মাখা চাহনি এখনো তাক করে আছে সিজানের দুচোখে। খুব মৃদু স্বরে সিজান বললো, ভালো থাকিস ‘ক্যামেলিয়া’।
কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে এমন করে ক্যামেলিয়া বলে ডাকল, যেন তনুকা সেটা শুনতে না পায়। এরপর স্টুডিওয়ের চেয়ারে বসে হাত দুটো উঁচুতে তুলে নিজে নিজেই বললো,
‘এইজন্যেই’।
স্কারবোরো, কানাডা