
স্বজন কিংবা বন্ধুর সঙ্গে আনন্দঘন সময়টা মুহূর্তেই মৃত্যুর বিভীষিকায় ঢেকে গেল ভয়াবহ আগুনে। রাজধানীর বেইলি রোডের একটি রেস্তোরাঁয় লাগা ওই আগুনে নিহত হয়েছে অন্তত ৪৪ জন। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৭ জন নারী রয়েছেন। আর জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে কাচ্চি ভাই নামে একটি রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ এ আগুনের ঘটনা ঘটেছে।
সর্বশেষ রাত আড়াইটা পর্যন্ত জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ৩৩ ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১০ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে রাতে একজনের মরদেহ ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে তাদের কারও পরিচয় জানা যায়নি।
রাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. সামন্তলাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংবাদ পেয়ে আমি দ্রুত চলে এসেছি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে দ্রুত আসতে বললেন। এখানে এসে যা দেখলাম তা ভয়াবহ অবস্থা। বার্ন ইনস্টিটিউটে এখন পর্যন্ত ১০ জন মারা গেছেন। অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৩ জন মারা গেছেন।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘যারা এখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন, তাদের বেশিরভাগের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। যারা বেঁচে আছেন তাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। ঢাকা মেডিকেলে ১৪ ও বার্নে ৮ জন চিকিৎসাধীন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সবাইকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আগুন নেভাতে তাদের ১২টি ইউনিট কাজ করেছে।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম জানান, রাত পৌনে ২টা পর্যন্ত মৃত অবস্থায় ৩ এবং ৭৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া একাধিকজন নিখোঁজ রয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুনে আহত ও নিহতদের বেশিরভাগই কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় খেতে আসা ব্যক্তি।
গ্যাস সিলিন্ডারের লিকেজজনিত কারণে আগুন লেগে থাকতে পারে বলে রেস্তোরাঁর কর্মীদের কাছ থেকে জানা গেছে বলে র্যাব সূত্র জানিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন লাগার কয়েক মিনিট পরই বিকট শব্দে গ্যাসের একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এতে পুরো ভবনের দোতলা ও তিনতলায় আগুনে পুড়ে যায়। ঘটনার সময় কাচ্চি ভাইসহ অন্য রেস্তোরাঁগুলো ক্রেতায় ঠাসা ছিল। রাত ১টা পর্যন্ত উদ্ধার তৎপরতা চলছিল।
আগুনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ভবনটির সামনে ভিড় করতে শুরু করেন ভেতরে আটকেপড়াদের স্বজনরা। সেই সঙ্গে উৎসুক মানুষের অতিরিক্ত ভিড়ে আগুন নেভানোর কাজ ব্যাহত হয়। জনতার মারাত্মক ভিড়ের কারণে তাদের সরাতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। পুলিশ ও আনসার সদস্যরা বারবার চেষ্টা করেও এসব উৎসুক মানুষকে সরাতে পারেননি। হ্যান্ডমাইকে দফায় দফায় অনুরোধ করার পরও লোকজনকে সরাতে পারেনি পুলিশ।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আহমেদ কামরুজ্জামান পরিবারসহ আটকে আছেন বলে সামাজিকমাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছে। জাহিদুর রহমান নামে একজনের ওই পোস্টে বলা হয়েছে, কামরুজ্জামান তাকে ফোন করে জানিয়েছেন তিনিসহ অন্তত একশজন ওই ভবনে আটকা পড়েছেন।
র্যাব সূত্র জানিয়েছে, সাততলা ভবনের অধিকাংশ ফ্লোরে রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি একটি মোবাইল ফোনসেট প্রতিষ্ঠানের শোরুম, কাপড়ের দোকানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আগুন লাগার খবর শুনে ভবনে উপস্থিত কর্মচারী-কর্মকর্তা সবাই দিগি¦দিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। ভবনটিতে লিফট ছিল একমাত্র ওঠানামার মাধ্যম। সিঁড়ি না থাকায় অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ভবনে আটকে থাকা লোকজন ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন। আতঙ্কে দুয়েকজনের ভবন থেকে লাফ দিয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। কেউ কেউ ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের অনেককেই ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা রাডারের সাহায্যে নিচে নামিয়ে আনেন। এ ছাড়া আটকে পড়া অনেককেই উদ্ধার করে।
ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি র্যাব, পুলিশ, আনসারসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ছুটে আসেন।
এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী, সদস্য সচিব ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন এবং সদস্যরা হলেন সংশ্লিষ্ট জোনের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি), সিনিয়র স্টেশন অফিসার এবং ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর।