14.5 C
Toronto
শনিবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৫

ফুটবলপ্রেমের আড়ালে মর্মস্পর্শী জীবনের গল্প

ফুটবলপ্রেমের আড়ালে মর্মস্পর্শী জীবনের গল্প - the Bengali Times
ভাঙাচোরা বাড়িতেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইয়ারজানের সাফ অনূর্ধ্ব ১৬ ফুটবলে সেরা গোলরক্ষক হয়ে প্রমাণ করেছেন চেষ্টায় স্বপ্ন ছোঁয়া যায় পঞ্চগড়ের হাড়িভাসা এলাকায়

অজপাড়াগাঁয়ে ভাঙাচোরা ঝুপড়ি ঘরে ক্লেশের ধুকধুকি জীবন। বাঁশের বেড়ার ফাঁক গলে বাইরে থেকে চোখে লাগে ঘরের ভেতরকার দুখী ছবি। দু’দিন আগেও ছিল এমনই চিত্রনাট্য। খোলনলচে বদলে গেল সব। এখন ওই ভাঙা ঘরে রোশনাই, গ্রামে তুমুল আলোড়ন। রোববার রাতে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের নেপালজয়ের পর দেশের নারী ফুটবলর মঞ্চে খোদাই হয়ে যায় এক গোলরক্ষকের নাম। কিশোরী ইয়ারজান আচকা হয়ে গেলেন বাংলাদেশের ‘প্রাণ’। ইয়ারজান বেগম যেন নারী ফুটবলের নয়া বিজ্ঞাপন। কারণ, ইয়ারজানই এখন ১৬ বছর বয়সীদের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গোলরক্ষক। ফুটবলপ্রেমের আড়ালে এ জয়িতার আছে মর্মস্পর্শী এক জীবনগল্প। সে গল্পটাই মানুষের মুখে মুখে ফিরছে।

পঞ্চগড় উপজেলা সদরের হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের খোপড়াবান্দি গ্রামে ইয়ারজানের বাস। ঠিকমতো দুইবেলা জুটত না খাবার। অভাবের ভেলা ঠেললেও হৃদয় গালিচায় অদম্য শক্তি তাঁর। লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুলে খেলাধুলায় থাকতেন মেতে। সময় পেলেই অন্য বান্ধবী নিয়ে নেমে পড়তেন মাঠে। এর ফলও পেয়ে যান হাতেনাতে। একটা সময় খোলে অনুশীলনের দরজা। জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন খেলার সময় ইয়ারজানের নৈপুণ্য মনে ধরে পঞ্চগড় টুকু ফুটবল একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমানের। এরপর পঞ্চগড় স্টেডিয়ামে টুকু ফুটবল একাডেমি থেকে তাঁকে দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ। তবে দারিদ্র্যের ঘূর্ণনে প্রতিদিন ১২ কিলোমিটার দূরে শহরের মাঠে প্রশিক্ষণে যাওয়ার রিকশা ভাড়া দেওয়ারও সামর্থ্য ছিল না ইয়ারজানের মা-বাবার। খাবার জোগানই সেখানে দুরাশা, সেখানে খেলার জন্য টাকা খরচ ছিল ‘আকাশকুসুম কল্পনা’। তবে চৌকস ইয়ারজান ঠিকই পেরিয়ে যান একের পর এক বন্ধুর পথ। সাফের বয়সভিত্তিক দলে জায়গা করে নিয়ে সবাইকে তাক লাগান। সব শেষ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে গোলরক্ষকের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ফাইনালে ভারতকে চেনান নিজের জাত।

- Advertisement -

এ জয়ের পর থেকেই আনন্দে ভাসছে ফুটবলপ্রেমীরা। রোববার রাতেই ইয়ারজানের বাড়িতে ভিড় করতে থাকে এলাকার মানুষ। গতকাল সোমবার সকালে তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জেলা শহরে থেকেও অনেকে গেছেন ইয়ারজানের বাড়ি। খুশির এমন মুহূর্তেও ইয়ারজানের বাবার কাছে নেই মিষ্টি কেনার টাকা। তাই প্রতিবেশীরাই এলাকার মানুষকে করান মিষ্টিমুখ।

ইয়ারজানের বাবা আবদুর রাজ্জাক দীর্ঘদিনের শ্বাসকষ্টের রোগী। চলাফেরা করতে পারলেও করতে পারেন না কাজ। মা রেণু বেগম অন্যের বাড়ি ও ক্ষেতখামারে দিনে ২০০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন। সেই আয় দিয়েই সচল দুই মেয়েসহ চারজনের সংসার।

ইয়ারজানের মা রেণু বেগম বলেন, ‘ফুটবল খেলার জন্য ইয়ারজানকে অনেক বকাবকি করতাম, ভয় দেখাতাম, মারধরও করেছি। কিন্তু সে লুকিয়ে চলে যেত খেলতে। পরে যখন বুঝলাম, সে ভালো খেলছে; তখন আর গালি দিতাম না। তবে খেলতে যাওয়ার জন্য রিকশা ভাড়াও দিতে পারতাম না। তাকে কখনও ভালো কিছু খাওয়াতে পারিনি। অনেক সময় সে না খেয়েই খেলতে চলে যেত। এখন সে বিদেশের মাটিতে খেলে ভালো করেছে।’

বাবা আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ইয়ারজানের মায়ের সামান্য আয়ে আমাদের খেয়ে-না খেয়ে থাকতে হয়। সরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতাও পাইনি। মেয়েকে ভালো কিছু খাওয়াতে পারিনি। কোনো কোনো দিন দুপুর ও রাতে ভাত দিতে পারিনি। এ জন্য আমি মেয়েকে খেলা বাদ দিতে বলেছিলাম।’

টুকু ফুটবল একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমান বলেন, ‘হাঁড়িভাসার মতো প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ইয়ারজান নিয়মিত শহরের এসে প্রশিক্ষণ নিত। এটা গ্রামের অনেকেই ভালো চোখে দেখত না। তার খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে অবাক হতাম। তার অনেক বড় স্বপ্ন। এখন সে স্বপ্নের অনেক কাছাকাছি। আশা করি, সে আগামীতে জাতীয় দলের হয়ে খেলবে।’

ফুটবলের এমন জয়ের পর আবেগী ইয়ারজান চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। কান্না চোখে তাঁর এই সাফল্যের ভাগ বাবাকেও দেন। বলেন, ‘সেরা গোলরক্ষক হওয়ার অনুভূতি একেবারেই আলাদা। প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নেমেই সেরা হয়েছি, শিরোপা জিতেছি।’ সূত্র : সমকাল

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles