-3.8 C
Toronto
বুধবার, মার্চ ১২, ২০২৫

‘আঁখি পিপাসিত নাহি দেখা’

'আঁখি পিপাসিত নাহি দেখা'

আজ বছরের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত দিনগুলোর মাঝে একটি। অত্যন্ত কুয়াচ্ছন্ন রহস্যগল্পের মত নীলাভ একটি দিন। দিনশেষের সুউচ্চ সান্ধ্যবাতি স্বভাবসুলভ ছড়িয়ে পড়তে না পেরে ছোট্ট পরিসরেই অশরীরী আলো ছড়াচ্ছে আর ছোট দিনকে বড় মনে করা শহরবাসী প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে বেথেলহেম নগরীতে জন্ম নেওয়া এক মহা শিশুর জন্মদিন পালনে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে উদযাপনে ধাবিত হচ্ছে। তারা মনেও করছে না বেথেলহেম এখন জ্বলছে- সঙ্গে জ্বলছে সমগ্র মানবজাতি।

- Advertisement -

এদিকে বাহনহীন আমি জনারণ্যে নির্বিকারভাবে মেকি ব্যাস্ততায় ভরপুর যান্ত্রিকজীবন দেখছি আর ভাবছি – আজ থেকে আঠারো বছর আগের এরকমই এক সন্ধ্যেবেলা, এমনই মন খারাপ করা রহস্যময় এক বিকেলে শুরু হয়েছিল আমার পতন। আর তারপর থেকে পড়েই চলেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় গ্রানাইটের কঠিন প্রস্তরে ঠেকে গেল পিঠ, কুড়মুড় শব্দে আর্তনাদ করে উঠল মেরুদন্ডের কশেরুকা। এই বুঝি শেষ সবকিছু- যন্ত্রণার অবসান। কিন্তু পরক্ষনেই টের পাই মেরুদন্ড হয়ত আরও একটু শক্ত হয়েছে। এখন গ্রানাইটের কঠিন স্লেট ভেদ করেও পতন অব্যহত আছে। এতগুলো পতনের অভিজ্ঞতাই হয়ত মেরুদন্ডকে কঠিন করে চলেছে অথবা ডিম। বছরের পর বছর ডিম ভক্ষণের কারনেও মেরুদন্ড কঠিন হয়। (লিখে রেখ এক ফোটা দিলাম শিশির।)

যদি চিন্তা কর, অসীম এই বিশ্বব্রক্ষান্ডের তুলনায় পৃথিবী নামক আমাদের এই গ্রহটি কত তুচ্ছ- বিন্দুসম। তবু আমাদের এক একজনের কাছে বিশালত্বের প্রতিক হল এই পৃথিবী।তেমনি ব্রক্ষান্ডের অসীম সময়ের তুলনায় মুহূর্তের মত পৃথিবীতে আমাদের জীবন। হয়ত কোনও এক মহাজাগতিক প্রাণীর একটি চোখের পলকে শূণ্যে মিলিয়ে যায় আমাদের কত প্রজন্ম। তবু একটি জীবনে কত কিছু করতে হয় আমাদের। গতবাঁধা রুটিনের মত কিছু কাজ- খাও- ঘুমাও- উপার্যণ- সংসার-সমাজ ইত্যাদি। আমরা যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে ঘুরে ঘুরে সান্নিধ্যে আসি কিছু মানুষের যাদের নাম দিই বাবা, মা, প্রিয় এবং প্রাণপ্রিয়। কিন্তু সকলেই নশ্বর, সকলেরই একটি করে গল্প রয়েছে যেখানে আছে সমাপ্তি।
তবে তুচ্ছ মানবদেহের অত্যন্ত অযৌক্তিক মন মানুষের এই সমাপ্তি মেনে নিতে পারে না। বোকা মনগুলো কেঁদে ওঠে অশ্রুসিক্ত কিংবা অশ্রুবিহীন। আবার অনেকে কাঁদে না কিন্তু কান্না ধারন করে বয়ে বেড়ায় সমগ্র জীবন। এরা জীবন্মৃত – দেহের মাঝে একটি ফাঁকা অংশ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, যা কখনোই পূর্ণ হবার নয়। প্রিয়জন চলে গেলে আমরা সেই মৃত্যুতে অভ্যস্ত হতে পারি ।

অভ্যস্ত হবার এই প্রয়াসে প্রতি বছর এইদিনে চলে যাই নায়াগ্রা ফলসে। কেন যেন পানির বিপুল স্রোতের মাঝে তাকে খুঁজে পাই, যেমনটা পাই নজরুলের কবিতায় এবং গানে। অদ্ভুত এক মানুষ ছিলেন তিনি। প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় নামায শেষে শুরু হত হারমোনিয়ামে নজরুলচর্চা। বাসায় বাকি সবার ঘুমের বারোটা বাজানোর পরে যখন অতিষ্ট হয়ে সামনে গিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বিখ্যাত বরিশাইল্ল্যা ঝগড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকি তখনই ঝড়ের পূর্বাভাসে সতর্ক নিরীহ মানুষটি আদরে হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে বলতেন- “সুরটা একটু ধর তো আমার সাথে ভিটু-মানা” ভিটু-মানা ছিল তাঁর দেওয়া আমার নাম। আর আমার বড় ভাই রানাটীর নাম ছিল ট্যাপা। আমার ছোট দুই বোন পর্যায়ক্রমে পিউ-সোনা এবং আড়াইশ গ্রাম। উদ্ভট এই নামকরনের রহস্য সবসময় অজানাই থেকে যাবে। আমি পুরো পৃথিবী খুঁজেও আর এর উত্তর পাব না।

জীবন কারও জন্য থমকে থাকে না, থাকা উচিতও না। কিন্তু প্রিয়জন না থাকার এই নীল কষ্ট বয়ে বেড়াই সবসময়ই। তাঁর লেজকাটা শিয়ালের গল্প, তাঁর আলাউদ্দিনের আশ্চর্য চেরাগ আর আলিবাবা চল্লিশ চোরের গল্প আজও পড়ি। আজও বেশিরভাগ সময় শুনি নজরুল সঙ্গিত, আজও প্রচন্ড ঝাল খাই- আজও হিংসা করি প্রতিটা মেয়েকে যে তাঁর বাবার ভালোবাসায় ডুবে থাকে।
মাত্র তেপ্পান্ন বছরের জীবনে তিনি পেয়েছিলেন পারফেক্ট স্ত্রী, ভালো পুত্র, সুন্দর যময কন্যাদ্বয় এবং প্রশ্নবোধক চিহ্ন যুক্ত একটি মেজোসন্তান। অগনিত গল্পের উৎস এই মানুষটি বিষাদসিন্ধুর গল্প বলতে বলতেই যেন চলে গেলেন হাসান হোসেনের অন্য এক বিশ্বে। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তাঁর সকল গল্প। তাঁর সাথে সাথে গল্পগুলোও যেন মরে গেল।
আবার হবে দেখা।

আমি জানি, যতই পাপ বা পূন্য করি না কেন-বিধাতা অসীম দয়ালু। আমার আবারও দেখা হবে, আমি আবারও হব ছোট্ট মমি, আবারও হারমনিয়ামের উপরে উঠে গাইব-
“খেলিছ, এ বিশ্বলয়ে
বিরাট শিশু আনমনে,
খেলিছ..
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে
খেলিছ।”

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles