
আমরা বাংলাদেশীরা কানাডায় ইমিগ্রান্ট হয়ে আসার পর কমবেশী যে সমস্ত চ্যালেন্জের মুখোমুখি হই তার মধ্যে অন্যতম হল আইডেন্টি ক্রাইসিস(Identity Crisis). কারন আমরা যে সমস্ত আইডেন্টিটি নিয়ে এ দেশে আসি তার বেশীর ভাগই কাজ করেনা। সেজন্য ইমিগ্রান্ট শিশুরাসহ আমরা মোটামুটি সবাই প্রথমদিকের দিনগুলোতে প্রচন্ড রকম “Identity Crisis” এ ভুগি। এ কষ্ট টাকাপয়সা না থাকার কষ্টের চেয়েও দুর্বীষহ ও ভয়াবহ। অনেকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। আবার অনেকেই শারীরিকভাবে অসু্স্থ হয়ে পরেন। সকাল, দুপুর আর রাতে কী খাইলাম, রাতে কোথায় ঘুমালাম–তা হয়ত কেউ দেখেনা। কিন্তুু আমার সামাজিক পরিচয় কী তাতো ঢেকে রাখতে পারিনা। বাংলাদেশে বড় কর্মকর্তা ছিলাম। এখন সিকিউরিটি গার্ড যদিও সিকিউরিটি গার্ড এর জব করা অসম্মানের কিছু নেই। বরং কাজ করে খাওয়াটা সব চেয়ে সম্মানের।
বাংলাদেশে একজন যে পরিচয়ে ছিলেন এখানে এসে সে পরিচয় অনেক ক্ষেত্রেই কাজে দেয়না। কষ্টটা তখন থেকেই শুরু হয়। বাংলাদেশে বেড়াতে গেলে আত্নীয় স্বজন জিজ্ঞেস করে: ওখানে কী করো? তার উত্তরে আমরা অনেকে টেকনিক্যালি বলি: “কানাডায় থাকি”। মানে কানাডায় থাকা টাই একটা Identity. কিন্তুু কানাডায় ভিতরে থেকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে? তখন কী বলবো? তখন তো শুধু কানাডায় থাকি বলে পার পাওয়া যায়না। এই যে জটিল মনো:সামাজিক যন্ত্রনা, তাতে কেউ পোড়ে নাই এমনটা বলা কঠিন। অনেকে তো এজন্য কানাডা ছেড়ে দেশে ফেরত চলে যায়।
বাচ্চারাও এ ক্রাইসিসে ভোগে। তারা ভাবে, তারা কী বাংলাদেশী না কানাডিয়ান? তারা কোন কালচারটা নিবে? বাংলাদেশী কালচার নাকি “কানাডিয়ান মেইস্ট্রিম কালচার”? বাচ্চারা এ সমস্যায় ভুগলে তাকে বলে “স্যান্ডউচ সিন্ড্রোম”।
আবার কিছু কিছু নারী আছেন, যারা হয়ত স্বামীর পরিচয় “আমার জামাই অমুক” দিয়ে পাড় পেয়ে যান। যদিও সেটি “তার আইডেন্টি না, সেটা তার আইডেন্টিটি ক্রাইসিস”। আবার পুরুষদের কেউ কেউ “আমি অমুক ছিলাম”, “আমি তমুক ছিলাম”, “আমার বাবা বা চাচা বা মামা এই ছিল সেই ছিল” বলে আইডেন্টিটির জানা দেন। এটাও আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। নিজেদের কমিউনিটিতে এটা অহরহ বলতে শোনা গেলেও অন্যান্য কমিউনিটিতে তার গুরুত্ব খুবই কম। সে ক্ষেত্রে কার কয়টা বাড়ি আছে, কে কত দামী গাড়ি চালায়–তা দিয়েও অনেকে আইডেন্টি ক্রাইসিস দুর করার চেষ্টা করেন।
তাহলে এই ক্রাইসিস দুর করার উপায় কী?
আমার তো মনে হয় বিষয়টা মনোভাবগত। আসলে আমরা বর্তমানে যে অবস্থায় আছি তা মেনে নিতে পারলেই সমস্যার সিংহভাগ সমাধান হয়ে যায়। অর্থাৎ বর্তমানকে সব চাইতে বেশী গুরুত্ব দেয়া। অতীতকে টেনে না আনাই ভালো। আমি কানাডায় এ মুহুর্তে যে অবস্থায় আছি তাকেই সেলিব্রেট করা। আমি যদি জিরো হয়ে থাকি এই জিরোকেই মেনে নেয়া, যদিও কোন মানুষই জিরো নন। প্রত্যেকটা মানুষের সম্ভাবনা অফুরন্ত ও বিশাল। নতুন দেশে এসে শুধু আমরা আমাদের অমিত সম্ভবনাটাকে টাইমলি ইউজ করতে হিমশিম খাই কিছু বাধার কারনে। তার মধ্যে “ভাষা” অন্যতম। ভাষা না জানা একটি বাধা। তা ছাড়াও নতুন এই সমাজ টাকে ভালোভাবে না জানা ও না বোঝাও একটা বাধা। চারিদিকে নানান রকম সুযোগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোন সুযোগটা কোনখানে রয়েছে তা না জানা একটা বাধা। অথচ একটু মনোযোগী হলে, একটু কষ্ট করলে, একটু লেগে থাকলেই এই বাধাগুলো দুর করা খুব সহজ। আর তখনই আমাদের Identity Crisis দুরীভূত হতে পারে।
টরন্টো, কানাডা