প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের (সেই ১৯৫৩ সালের আগে জন্মানো প্রজন্মের) সমস্যা কী জানেন? তারা বলে বেড়ায় যে তারা ছিল সাধু গাছের কদু। তারা নাকি বাপ-মায়ের কথা শুনতো, মন দিয়ে লেখা-পড়া করতো, গুরুজনদের আদেশ পালন করতো, বাইরে বাইরে ঘুরতো না, প্রেম করতো না, ভাজা মাছটা উল্টিয়ে খেতে পারতো না।
তাদের ভাব দেখে মনে হয় তারা ছিল ফেরেস্তা, আর বর্তমান প্রজন্ম হচ্ছে ফাজিলের আঁটি। বর্তমান প্রজন্ম নাকি সারাদিন চোখের সামনে মোবাইল ধরে রাখে, অল্প বয়সে সাত-আটটা প্রেম করে, ছেঁকা খেয়ে নাকি দাঁত কেলিয়ে হাসে, পড়াশোনায় মনোযোগ নাই, ভাত খায় না; খায় শুধু বার্গার।
আর তারা কি করতো জানলে বর্তমান পোলাপানের চক্ষু চড়কগাছে উঠতো। সপ্তাহে পাঁচ দিন যেতো সিনেমায়। সিনেমার গল্প ছাড়া মাথায় কিছু ছিল না। আর চব্বিশ ঘন্টা ভাই রে ভাই.. দিন রাত রেডিও আর রেডিও। স্বপ্নের মধ্যেও। নানীর নানী, দাদীর দাদী হাজারবার বলতো কর্তা কে- “বাজারে যাও বাজারে যাও..”.। ওমা, কানেই নিতো না! যাচ্ছি যাচ্ছি বলতে বলতে বিকাল হয়ে যেতো। তারপর বলতো, কাল যাই? কর্তাগণ ঘর সংসার বাদ দিয়ে চায়ের দোকানে দিতো খালি আড্ডা। আর সত্তরের দশকের পর চোখের সামনে চলতো টিভি; যে নেশা রে..
এসব শায়েস্তা খাঁ আমলের জনগণ এখন এমন ভাব করে যেন তারা ছিল বাবা-মায়ের আদর্শ সন্তান। অথচ তারা কি পড়াশোনার ধারে কাছ দিয়েও যেত? সারাদিন শুধু টো টো। স্কুলে যাওয়ার নাম নাই, সারাদিন ক্যারাম খেলো, বিড়ি ফোঁকো, সাঁতার কাঁটো, কাদায় মাছ মারো..। আর কে কতো চুরি করতে পারে; সেই প্রতিযোগিতা। এর বাড়ির ছাগল চুরি, ওর বাড়ির গরু, মুরগি। লুকায়ে জবাই করে বনভোজন করে আবার সেই বাড়িতেই এক বাটি মাংস পাঠিয়ে দিতো। এগারো বছরে বিয়ে করতো, বারো বছরে হতো মা-বাপ। ২৫ বছরে হতো নানা-নানী, দাদা-দাদী। ধুমসে চলতো বাল্যবিবাহ।
আর তারও আগে, মানে রেডিওরও আগে ছিল বাইস্কোপের নেশা। বাক্সে চোখ লাগিয়ে সারাদিন দেখতো নায়ক নায়িকাদের ছবি। ছিঃ! প্রেম করতো, চলতো চিঠি চালাচালি। লাইলী মজনুকে না পেলে হলো; সোজা গলায় দড়ি, ইঁদুর মারা বিষ! বর্তমান যুগে কয়জন প্রেমের কারণে গলায় দড়ি দেয়, আর তারা কতজন দিতো হিসাব আছে? আর ছিল খেলার নেশা। হাডুডু, ফুটবল, ডাঙ্গুলি, মার্বেল, লাটিম, রুমাল চুরি, কুতকুত। বাপ মা কে কোনো হেল্পই করতো না।
আর তাদেরও আগে, মানে দাদার দাদার দাদার দাদার আমলে চলতো যাত্রা। সব কিছু ফেলে চলো যাত্রায়। ওরা ছিল আরও বদ। সারা রাত ধরে নেশার মতো রংগিলা, রঙিন রূপবান দেখে ফুপায়ে ফুপায়ে কাঁদতো। বাড়ি ফেরার নাম নাই। কেউ কেউ আবার ফিরতোই না, যোগ দিতো যাত্রা পার্টিতে। যাত্রার নেশা আরও মারাত্মক। অথচ ওরাই দেখবেন এখন সাধু সেজে বসে বসে “সব শেষ সব শেষ” বলতেছে।
এদের জ্বালায় গাছের বড়ই, জাম, তেঁতুল, আম, কাঁঠাল, লিচু কিচ্ছু থাকতো না। সব পেরে সাফ! আর খেতো মইষের মতো। ভাই রে ভাই, থালের পর থাল চালান করতো চোখের নিমেষে। এমন ভাব করতো, যে বেশি খাওয়াটা হলো আসল কাম। একেকজনের কি ভুরি ছিল! গোসল করার সময় সাবান-শ্যাম্পু মাখতো না, বগলে মাখতো না ডিও।
যত দোষ নন্দ ঘোষ!