অন্তরে দগদগে ক্ষত আর অনেকটা অবচেতন অবস্থাতেই তিনি কিংস্টন রিহাবের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। টরোন্টোর পাশ দিয়ে নদীর মত বয়ে চলা হাইওয়ে অব হিরোজ-৪০১ ধরে মার্সডিজ বেন্জটি শাঁশাঁ করে পুর্বদিকে এগুতে লাগল। গাড়ির ভিতরে প্যাসেন্জার সিটে বসা লোকটির দিকে মাঝখানের সিটে বসা সাহানা চৌধুরী একবার চোখ মেলে তাকাল মাত্র। তাতেই তার শরীর ঘিন ঘিন করে উঠল। কেন এরকম অনুভূতি হল তিনি বুঝতে পারলেন না। তারপর গাড়ির জানালা দিয়ে আকাশের দিকে আনমনে তাকিয়ে রইলেন।
মানুষ যেভাবেই দেখুক না কেন- আসলে আকাশ বলে কিছু নেই। যেরকম দেহের ভিতরে মনের অবস্থান কোথায়, তা যেমন বোঝা যায়না তেমনি মন, মনন, অনুভূতি-এগুলোরও কোন অবস্থান বোঝা যায়না। এসব আসলে মস্তিস্কের লীলাখেলা। দেহের স্নানুবিক ব্যাপার-স্যাপার। আকাশ বলে মানুষ যেটা ভাবে, আসলে সেটা মানুষের দৃষ্টি সীমার শেষ সীমানা মাত্র। অথচ অন্ধকার রাতে মানুষের দৃষ্টির সীমানা কতইনা বেড়ে যায়!
মানুষ কোটি কোটি মাইল দূরের অজস্র তাঁরার মেলা গভীর আগ্রহ আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। দেখতে ভালো লাগে বলেই হয়ত দৃষ্টির সীমানা প্রসারিত হয়। মানুষের ভালো লাগার সময়ও হয়ত প্রসারিত হয়। কখনো কখনো।
বরফপড়া শীতের দিনগুলোতে শাদা ধবদবে তুষার ছুঁতে মন তার চায়। গ্রীষ্মে মেপললিপের নীচে দাঁড়িয়ে ঝিরিঝিরি পাতার শব্দে মন হারিয়ে যায়। ছিঁপছিঁপে হাম্বার নদীর কম জলে পা ভিঁজাতে ভিঁজাতে হাড়িভাঁঙ্গা নদীর কথা মনে পরে। খরস্রোতা সেন্ট লরেন্স পাড় ধরে হাঁটা যমুনা পাড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। রকির পাঁদদেশে আঁকাবাঁকা পথে চলতে চলতে মায়ের সাথে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে বেড়ানো দিনগুলো আবছা আলোর মত মনের মধ্যে নেভে আর জ্বলে। তৃন্দ্রা অঞ্চলের মেরুখরগোশের কান উঁচু করে তাকিয়ে থাকা, উত্তর মেরুর বরফ গলা নদীতে সাদাভাল্লুকের সাঁতার কেটে সিল মাছ শিকার, রেইনডিয়ারের ধাঁরাল ক্ষুরে বরফ ভেঙ্গে হেঁটে চলা, সময়ের সাথে সাথে আর্কটিক শেয়ালের রং পরিবর্তন-ধুসর থেকে সাদা হওয়া- সবই সাহানা চৌধুরীর মনে পড়তে থাকে। শুধু পরিবর্তন হতে চায়না তার মন।
টরন্টো থেকে সোঁজা পুর্ব দিকে কিংস্টন সিটির নিকটবর্তী থাউজেন্ড আইল্যান্ডের দূরত্ব প্রায় সোয়া তিনশো কিলোমিটার। ইতোঃমধ্যে সাড়ে তিন ঘন্টা কেটে গেছে। এখানকারই একটি দ্বীপে একচালা একটি বিশাল বাংলো বাড়ির সামনে গাড়িটি থেমেছে। গাড়ির মধ্যে তিনজন মানুষ। কেউ কোন কথা বলছে না। ড্রাইভিং সিটে যিনি বসে আছেন তিনি পকেট থেকে সেল ফোনটি বের করে কাকে যেন ফোন করলেন। ফোনের রিং টন বাজল। অন্যদুজন তা শুনতে পেলনা।
হ্যালো, মাই নেজ ইজ গিয়াস উদ্দিন। আই এ্যাম হেয়ার ফ্রম টরন্টো। আই হ্যাভ ব্রট সাহানা চৌধুরী ইন হেয়ার টু ড্রফ হার ওফ পর ট্রিটমেন্ট।” ফোনের ওপাশ থেকে কী বলল জানা গেল না। তবে দু-মিনিট পরে একজন মধ্যবয়স্ক শাদা মহিলা দুজন পুরুষ সিকিউরিটি গার্ড নিয়ে গাড়ির কাছে হাজির হল। তার হাতে একটা নীল রংঙের ফাইল।
ভদ্রমহিলা গাড়ির কাছে এসে নিজের পরিচয় দিল। তারপর ফাইলের ভিতরে কাগজে কয়েক সেকেন্ড চোখ বুলিয়ে বলল, হু ইজ সাহানা চাউধুরি? প্যাসেন্জারে সিটে বসে থাকা পুরুষ লোকটি পিছনের সিটে বসা আধা-ঘুমন্ত তিরিশোর্ধ একজন নারীকে দেখিয়ে বল, ইনিই সাহানা চৌধুরী।”
মধ্য বয়সী শাদা মহিলাটি সাহানার সাথে কিছুক্ষন কথা বলল। তারপর সে ওনাদের সাথে বাঙলোর গেটের দিকে রওনা হল। সাহানাকে ভেতরে নিতে পুরুষ সিকিউরিটি গার্ডদের কোন হস্তক্ষেপ করতে হলনা। সাহানাক চৌধুরীরে সাথে আসা গিয়াসউদ্দিন তাদের সাথে সাথে ভিতরে ঢুকে গেল। তারপর কিছু ফর্মালিটিস সম্পন্ন করে টরেন্টোর উদ্দেশে রওনা দিল।
সাহানা চৌধুরীকে আলাদা একটি এক তলা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল।
কিংষ্টনের এই ডিটক্স এন্ড রিহাব সেন্টারে সাহানা চৌধুরীকে কয়দিন থাকতে হবে তার সঠিক হিসেব এ মুহূর্ত বলা যাচ্ছে না। তবে মাস খানেক তো অবশ্যই। বেশিদিনও লাগতে পারে। তাকে একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হল। রুমটি সুন্দর করে সাঁজানো। জামাকাপর না খুলেই তিনি বেডের ওপর কিছুক্ষন বসে রইলেন। পাঁচ মিনিট পরে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
তিনটার দিকে ঘুম ভাঙ্গল। ঘরটির কোনে একটা টেবিলে খাবার দেয়া ছিল। একটা চিকেন স্যান্ডউচ আর এক গ্লাস আপেল জুস। পানির বোতলও ছিল। তিনি খেয়ে নিলেন। তার কাছে কোন সেল ফোন নেই। এখন কী করবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না । হঠাৎ বিছানার পাশে রাখা টেলিফোনটি বেজে উঠল। তিনি রিসিভার উঠালেন।
– হেলো, সাহানা স্পিকিং।
-আপনি কী পাশের রুমে ড: রেবেকার সাথে এখন একটু দেখা করতে পারবেন? উনি আপনার সাথে কথা বলতে চান। অবশ্য আপনি আজকে কথা বলতে না চাইলেও অসুবিধা নেই।
-জ্বি, পারবো।
সাহানা চৌধুরীর রুমের দরজার কাছে পৌছতেই দেখতে পেলেন একজন ষোটোর্ধ নারী একটা ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
– হেলো সাহানা। আই এ্যাম ডঃ রেবেকা প্যাটারসন, সাইকোলজিস্ট। প্লিজ কাম ইন।
সাহানা চৌধুরীকে রুমের ভিতরে একটি চেয়ারে বসার অনুরোধ করলেন। সাহানা সেটাতে বসলেন।
-আমি আপনার সাইকোলজিস্ট। আপনার সাথে কিছুক্ষন কথা বলতে চাই। আপনি কথা বলার মত অবস্থায় আছেন তো?
-জ্বি, আছি।
-আপনার সম্পর্ক এ একটু বলবেন। মানে আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড। কীভাবে এখানে আসলেন? এসব আর কী।
সাহানা চৌধুরীর ইংরেজী খুব ভালো। সে ইংরেজীতেই শুরু করল।
– আই এ্যাম শাহানা চৌধুরী, আ বাংলাদেশি ক্যানাডিয়ান। টরন্টোর ডাউনটাউনে একটা ফ্লাটে থাকি। আমি আসলে কিছু করিনা। আই মিন আমার কোন প্রফেশন নেই। যদিও আমি এমবিএ করেছি কানাডার একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। চাইলে যেকোন একটা জব করতে পারি। আসলে দরকার হয়না। যে ফ্লাটে আমি থাকি সেটা আমার ফাদার চার মিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে দিয়েছে। আমি দশ বছর আগে আমেরিকায় পড়াশোনা করতে এসেছিলাম। তারপর টরন্টোতে চলে আসি। আমার বাবামা কানাডার সিটিজেন। আমিও। বাবামা এখানে থাকেন না। বাংলাদেশে থাকেন। ওখানে আমাদের বিজনেস আছে। আমি বিবাহিত। একা থাকি। আমার স্বামী আমার সাথে থাকে না। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। সে বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশেই থাকে। গত সপ্তাহে আমি আত্নহত্যা করতে চেয়েছিলাম। আমার কিছু মানসিক সমস্যা আছে। ঘুমাতে পারিনা। সাথে এডিকশনও আছে। আমার বাবা ও শ্বশুর অনেক ধনী। তাদের অনেক টাকা-পয়সা। টরন্টোতে তারা দুজনেই কয়েকশ মিলিয়ন ডলার নিয়ে এরসছে। হাউজিং সেক্টরে সে টাকাগুলো বিনিয়োগ করা হয়েছে। আমি প্রতিমাসে কমপক্ষে ১০হাজার ডলার খরচ করি। নিজে গাড়ি চালাই না। সব সময় উবার ইউজ করি। রান্না করিনা। উবার ইটস ব্যবহার করি। আর প্রচুর ঘোরাঘুরি করি। ক্যানাডার কোথায়ও যাওয়া বাদ নেই। অন্যান্য দেশেও ঘুরতে যাই। কিন্তু জানেন আমার মনে কোন সুখ নেই। আমার মনে অনেক কষ্ট।
-আপনার মনে কিসের কষ্ট?
-আমার কষ্টের শুরু ছোট বেলা থেকে। আমার কখনো টাকাপয়সার কষ্ট হয়নি। আমার কষ্ট অন্যখানে।
-কী সেটা? বলা যাবে?
-আমি যখন গ্রেড ফাইভে পড়ি তখন থেকে আমার চাচা (বাবার চাচাত ভাই) আমাকে অনেকবার রেপ করেছে। আমি কখনোই সে কথা কাউকে বলতে পারিনি। তখন থেকেই পুরুষ মানুষ দেখলেই আমার ভয় লাগে।
-মাকেও বলেননি?
-না। কখনোই সাহস হয়নি।
-তাহলে বিয়ে করলেন কীভাবে?
-উনি আমার চাচার ছেলে। যে চাচা আমাকে রেপ করেছিল। আমার স্বামীর সঙ্গে কখনো আমি সেক্স করিনি। কীভাবে করবো? তার বাবা আমাকে রেপ করেছে। এ কথা তো আমি আমার স্বামীকে বলতে পারিনা। পারবোও না। আমি কখনোই বিয়ে করতে চাইনি। আমার বাবা আর আমার সেই চাচা মিলে আমাকে ওর সাথে বিয়ে দিয়েছে। বাবার আমি একমাত্র সন্তান। আমার শ্বশুর বাংলাদেশের অনেক প্রভাবশালী লোক। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তার সহজ যোগাযোগ। তার মাধ্যমেই আমার বাবা এত বড়লোক। তার কথার বাইরে যাওয়ার কোন সাহস আমার বাবার নেই। আমার মায়ের সাথেও সেই চাচারও সেক্সুয়াল সম্পর্ক। এটা আমার বাবাও জানে। কিন্তু কিছু করতে পারেনা।
আমার স্বামী অবশ্য খুব ভালো ছেলে। যখন আমার কাছে আসে আমি অন্যঘরে ঘুমাই। আমাকে সে কখনো জোর করেনা।
– আপনি সুইসাইড করতে গিয়েছিলেন কেন?
– আমি অনেকবার সুইসাইড করতে চেয়েছি। কিন্তু মরতে পারি নাই। গত সপ্তাহে আমার মা মারা গেছেন। আমার মা ছিল আমার একমাত্র নির্ভরতার জায়গা। সেও চলে গেল। আমি বেঁচে থেকে কী করবো? সেজন্য ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্নহত্যা করতে চেয়েছিলাম।
-আপনি এডিকশনে আসলেন কীভাবে?
-ছোটবেলায় আমার ওপর যে যৌন হয়রানী করা হয়েছিল তারপর থেকে সেই অপমান, সেই কষ্ট ভুলে থাকতে আমি প্যারাসিটামল খাওয়া শুরু করি।
বাংলাদেশে থাকতে আমি জানতাম, প্যারসিটামল ব্যাথা দূর করে। তারপর যখন আরো একটু বড় হলাম তখন ফেনসিডিল খাওয়া শুরু করলাম। আমার এক বান্ধবীর ভাই আমাকে ফেন্সিডিল কেনার ব্যবস্থা করে দিত। ওটা খেলে সেই কষ্টের কথা ভুলে থাকতাম। এভাবে ফেনসিডিলে আসক্ত হয়ে পরি। তারপর হাইস্কুল শেষ করার পরে আমেরিকায় চলে আসি। কারন আমি সুযোগ খুঁজছিলাম কীভাবে দেশ থেকে বের হবো? দেশ থেকে চলে গেলেই হয়ত আমি আমার ভয় থেকে মুক্তি পাবো। আমি পড়াশোনায় খুব মেধাবী ছিলাম। ইংরেজি ও অংকে ভালো ছিলাম। আমি দেশ থেকে বের হতে পেরেছিলাম।
-তাহলে তুমি কী নিজেকে এখন মুক্ত মনে করো না?
-না, আমি নিজের জেল খানায় আটকে আছি। আমি বিবিএ করেছি। এমবিএ করেছি। কোন দিন চাকুরীর চেষ্টা করিনি। কারন আমার টাকার অভাব নেই। আমি আমেরিকায় থেকেই নতুন ড্রাগ ধরেছি। এটা ফেন্সিডিলের চেয়ে আরো বেটার মনে হয়। ক্টিষ্টাল মেথ। একবার নিলে অনেকদিন কষ্ট ভুলে থাকা যায়। মানুষ আমাকে বলে তোমার বাবা এত ধনী, তোমার এত কষ্ট কেন? আমি কোন জবাব দিতে পারিনা।
-যারা তোমাকে এখানে দিয়ে গেল তারা কারা?
-আমার স্বামী আর দুর সম্পর্কর এক চাচাত ভাই।
– কী হলে তুমি সুখ পাবা?
-আমাকে যদি গ্রেড ফাইভের সেই বয়সটি ফিরিয়ে দিতে পারো তাহলে আমি সুখি হবো।
-সাহানা, আমরা আপ্রান চেষ্টা করবো তোমার সেই সুখ ফিরিয়ে দিতে।
ডঃ রেবেকা আবার কালকে কথা বলবেন বলে আজকের মত কথা শেষ করলেন। সাহানা চৌধুরী ডঃ রেবেকার ঘর থেকে বের হয়ে তার কামড়ার দিকে হাঁটতে লাগল।
কিংস্টন শহরের আকাশে তখন দিনের অস্তগামী সুর্যটি আরো লাল হয়ে উঠেছে। ঠিক ভোরের সুর্য্যর মত। শহরের মেঘমুক্ত পশ্চিম আকাশটি অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার আগে কী রকম ঝঁকঝঁকে মনে হচ্ছে।