
বিকেলের আগে যে ভোর এসেছিল জীবনে তারই কিছু ছিন্নপত্র লিখতে বসেছি আজ।
যার চোখ তাকে যদি আর মনে না পড়ে তবে সেটা অতীতই বটে। অতীত তাই, যা এক সময় ঘটেছিল এবং হয় মনে আছে কিংবা মনে নেই, এমন সব সংশয়।
স্মৃতি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন, স্মৃতির রঙ সবুজ। টকটকে লালের মতো সবুজ। স্মৃতির বেলা-অবেলা বলে কিচ্ছু নেই। পূর্বে ঘটেছিল বটে তবে, মন চাইলে এখনও দেখা যায়। যেমন; ঘাড় ঘুরালেই তুমি। আজীবন তোমার আঙ্গিনায় আমার অবাধ পায়চারী।
উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি – একটি গ্রামের নাম ছিল নির্জন কান্দি। আমরা দুজন মিয়া বাড়ি আর চৌধুরী বাড়ির সন্তান। আজ থেকে অনেক বছর আগে তোমাকে ইশারা দিয়ে বলেছিলাম ভেতরে চলে যাও।
ওদিক থেকে তুমি ইশারা করলে কেন যাবো! তোমাকে আরো দেখবো।
এদিক থেকে আকাশের দিকে তর্জনী তুলে বললাম সন্ধ্যা হয়ে এলো যে।
ওদিক থেকে তুমি আকাশকে কাঁচকলা দেখিয়ে অপলক চেয়ে রইলে আমার দিকে এবং ভুরু উঁচিয়ে বললে
কী! এইতো চাওয়া হচ্ছিল যেন আমি সত্যি সত্যি ভেতরে চলে না যাই।
আরও একটু ঘোলাটে করেই বলি। ঘটনাকাল উনিশ’শ সাতচল্লিশ সালের পরের একটি সময়। তখন লাটাইয়ের মতো সুতোয় বাঁধা থাকতো চোখে। প্রেক্ষাপট, হেলাল দেওয়া বারান্দা কিংবা গলির ছোট পথে সন্ধ্যা পায়চারী। পথের ধারেই এক চিলতে দাঁড়াবার যায়গা। অনবরত রিক্সা যায় ঘণ্টি বাজিয়ে। কে গেল কে এলো তার শব্দ চলে আসে অন্দর মহলে। কাছেই একটা নদী ছিল। কাঁঠাল পাতা পড়ে থাকতো চলার পথে। ভিজে যাওয়া পথের একদিক থেকে হেঁটে আসতাম আমি তাই দেখে শ্লথ হতো তোমার চলার গতি। আবার কলেজের লম্বা বারান্দার রেলিং এ দুজনের হাত থাকতো চেপে। যদিও দুটো শরীরের দূরত্ব যেন শহর থেকে মফঃস্বল। তবুও, অতোটুকুই ছিল ছোঁয়ার আনন্দ।
তখনকার দিনে সর্বজন অমন পরিণতিকে ভালোবাসা বলে চিহ্ন করলেও আমি তাকে বলি প্রেম। প্রেম কিন্তু ভালোবাসা নয়, কুঁড়ি যেমন ফুল নয়। অথচ দুটোর জন্ম একই উৎস থেকে।
ফুল ঝড়ে যায়। কুঁড়ি সম্ভাবনাময়। তুমি আমি আজীবন কুঁড়ি হয়ে বেঁচে আছি। এক কুঁড়ি এক, এক কুঁড়ি দুই, তিন চার… আমরা অন্তকালের সম্ভাবনা। সমাপ্তি আমাদের টানে না।
যে জানার সে জানে, প্রেমে বিরহ নেই। নেই বিচ্ছেদ। প্রেম বহমান। প্রেম আশা-চিরন্তন।
কিছু কদম কদম ভালোবাসা দেখেছি জীবনে। পরবর্তীতে তাদের কিছু অংশ পা গুণে গুণে ফিরে গেছে অন্যত্র। তাই বলি, ভালোবাসায় প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে। প্রেমের নেই সেই সংকট। প্রেম গভীর এষণ। শেষ হয়েও হয় না শেষ।
যে ভালোবাসে সে হয়তো সুখী হয়। আবার দুঃখ ফেরী করে ঘুরেও বেড়ায়। দেখেছি ভালোবাসায় উৎসব হয়। তাতে অনেক আনন্দ। প্রেমে উৎসব অনুপস্থিত। শুধুই অনুভূতি।
প্রশ্ন হতে পারে জীবনের সমতল থেকে এতোটা উঁচুতে দাঁড়িয়ে আজও কেন সব সুমধুর লাগে? উত্তর হলো – এটা প্রেম শক্তির ফলাফল।
জীবন রেখার চিহ্নিত ভগ্নাংশে দাঁড়িয়ে আজ পত্র লিখতে বসেছি। যদি বলি কৈফিয়ত তাতে অপরাধীর সুর বেজে উঠবে। বরং বলি স্বীকারোক্তি। ধরে নেওয়া যাক লেখা হচ্ছে অন্তিম পত্রালাপের প্রথম খণ্ড। নিকট অতীত নয় বরং বশীভূত তিলোত্তমা যুগের কথা বলছি বেহালা বাজিয়ে। সুর ও ধ্বনি বিলাপে বসিয়ে।
মজুমদার স্যার আমাদের ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন। রাশিদ স্যার ভূগোল। তিনি বলেছিলেন পৃথিবীর বিরাট অংশ অরণ্য। শ্রাবণের বারিধারা পড়ে এখানে। সাগর বন্দী হয়ে থাকে উপচে পড়া ঢেউ। পায়ে পায়ে মানুষ হাঁটে পৃথিবীর বুকে। সেই পৃথিবীতেই আমার জন্ম। আদম হাওয়ার মতো নয়। আমরা কাছে এসেছিলাম সম্পূর্ণ মানুষিক প্রয়োজনে, এক নির্জন দুপুরে। দূর থেকে কাছে তবুও দূরেই রয়ে গেল অস্তিত্ব। মহা পাপ হয়ে যাবে এতোটাই ভয় ছিল মনে। তাই আকাশের মাঝে খুঁজেছি আকাশ। এক ফালি রোদ্দুর ছুঁয়ে গেল গিলাবের মতো জোড়া নিঃশ্বাস। এইটুকুই শুধু প্রাপ্তি।
‘নিকট-দূর’ – এই দূরত্ব রেখেই অচিরেই চলে যাব অজানা কোন দেশে। তারই প্রস্তুতিতে প্রাণ-সীমান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। ইদানীং চোখের কাঁচ দুটো অহেতুক ভারী হয়ে যাচ্ছে। এই তো সেদিন বিরাশিটি মোমবাতি জ্বালিয়ে কেটেছি তুলতুলে কেক। মুখের সামনে কেক উঠিয়ে ছবি তুলেছে প্রিয়জনেরা। মিষ্টি খাওয়া একেবারেই বারণ। শুধুই ছবি ধারণ।
যাক সেসব, এই পত্র জেন্ডার নিউট্র্যাল। বেনামী। লেখক পত্রকর নয় একথা গুণীজনেরা মেনে নেবেন। ধরে নেওয়া যাক পাঠকই পত্রের রচয়িতা। নতুবা, যে মুখে শ্রাবস্তীর কারুকার্য সেই মানুষটিই হয়তো লিখছে এই পত্র। অথবা হাঁটতে হাঁটতে চাকার নিচে পৃষ্ঠ হয়ে গেছে যে যুবকের চোখ তার হাতেই উঠেছে কলম। জীবনের হালখাতা কিংবা জ্যোতিষীর খড়ি পাতা দেখে কেউ যদি খুঁজে পায় কোন নাম। ওরা নিশ্চয় খুঁজে পাবে বর্ণমালার সাদৃশ্য। একটু ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে লিখলে নিজের নামই মনে হবে তাদের কাছে।
মনেরও মন আছে এমন মানুষই পত্র প্রাপক। যে প্রেম মিলনে মিলিয়ে গিয়ে হয়নি ভালোবাসা, চাইবো সেই প্রেম যেন বেঁচে থাকে অন্য ভুবনেও। প্রভু, ভালোবাসা দিও তাদের যারা প্রত্যাশা করে আলিঙ্গন। আমি উষ্ণ হৃদয়ে করে যেত চাই শুধুই অন্বেষণ।
আজ এখানে ইতি রাখছি। যদিও বা প্রাণ-সীমান্ত পথে হাঁটছি। অন্তিমে পৌঁছোবার আগে হয়তো লিখতে পারবো আরো দুচারটি এক পৃষ্ঠার চিঠি। সব খামে লেখা থাকবে প্রাপক প্রাক্তন। ইতিতেও তাই। প্রাক্তন।
স্কারবোরো, কানাডা