
কবিতা ভালো লেগেছে সেটাই তো যথেষ্ট। আবার কেন দেখতে আসা!
স্বভাবে নরম গোছের লোক এই কবি। কথা বলেন দাড়ি কমা দিয়ে। শুরু করেছিলেন খুব নিচু স্বরে, এখন মাথা নত করে বললেন, লোকে কবিকে দেখতে এসে দেখে যায় আস্ত একটি মানুষ। মানুষ কি কবিতা লেখে? লেখে-তো মানুষের মন। সেই মনটা দেখতে আসে কজন?
মালিহা এতক্ষণ চুপচাপ হাসি মুখ করে বসে ছিল। মুখে হাসি থাকলেও তার চোখ ডানা মেলে কবির মুখের ওপর প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে।
কবি এবার মালিহার দিকে তাকালেন। বললেন, এই যে আমাকে দেখতে এলেন, কবিতার ঝিনুক কি খুঁজে পেলেন। আমি কবি প্রভাত মজুমদার…. কবি একটু জিরিয়ে নিলেন। ছোট্ট চারপায়ার ওপর পিরিচ দিয়ে পানি ঢাকা। সেটার দিকে একবার তাকিয়ে ভাবলেন থাক। শান্ত নির্জলা একজন কবি ভক্ত সামনে বসে থাকা অবস্থায় পানির তৃষ্ণা লাগা মানায় না। থেমে থাকা কথা আবার শুরু করলেন।
এত দূর আসতে কষ্ট হয়নি তো?
না কোন কষ্ট হয়নি। বরং আসার পথে মন খুব প্রফুল্ল ছিল। আপনার সাথে দেখা করার ইচ্ছে অনেকদিন থেকে। তাই এতো দূর চলে এসেছি। যদি সাথে নিয়ে কোন হাঁসপাতালে ভর্তি করে দিতে পারতাম তবে অনেক খুশি হতে পারতাম। কিন্তু আপনি তো বারংবার মানা করে যাচ্ছেন গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাবেন না। পত্রিকায় এসব পড়েছি।
না আসলেই ভালো করতেন। আপনাকে দেখে মায়া লেগে গেল। বেঁচে থাকার সাধ জেগে উঠলো। বাঁশীর সূর দূর থেকে শুনতে হয় ধেনু বালককে না দেখে। কবিতাও পড়তে হয় কবির মুখ মনে না করে।
কিন্তু আপনি তো একটি মেয়ের মুখ না দেখেই এতোগুলো বছর ধরে কবিতা লিখে যাচ্ছেন। প্রতিটি কবিতাতেই সেই একই মেয়ের কথা। মেয়েটি আসলে কে?
নিজের সর্বনাশ ডেকে আনলেন আপনি। সাথে আমাকেও শেষ করে দিলেন। ভেবেছিলাম যতদিন বেঁচে আছি দুচারটা কবিতা লিখে যেতে পারবো। কিন্তু আপনি আমার কল্পনার সব জল ছেঁকে নিয়ে গেলেন। আপনাকে না দেখলেই ভালো হতো।
শুনেছি কবিদের অনেক সাহস থাকে। সাহস করে বলেই ফেলুন না আমি কি আপনার থইথই’র মতো দেখতে?
থইথই তুমি ভালো আছো। কালোর মধ্যে তোমাকে উজ্জ্বল লাগে কেন।
দেখেন তো আপনার কবিতার থইথই কি আজ সামনে বসে আছে কি না। চাইলে পিঠের তিলটাও দেখিয়ে দিতে পারি।
না না ওসব করবেন না। আমি একটি তিল কল্পনা করে রেখেছি নিজের থেকে। আর নাকের গড়ন, কণ্ঠস্বর এগুলোও নিজস্ব কল্পনা। আপনার উচ্চতা…
আমি জানি ওসব.. মালিহা কবিকে থামিয়ে দিয়ে বলে, হয়তো আপনার নিজের কাছেও আপনার লেখা সবগুলো কবিতা নেই। নেই সাক্ষাতকারের কপি। আমি সব জমা করে রেখেছি। আমার পড়ার ঘরের বিশেষ একটি স্থান আপনার জন্য বরাদ্দ করা আছে।
মালিহার দিকে তাকিয়ে কবি বলেন এমন আশ্চর্য মিল আমি কখনো আশা করি নি। এই যে আপনাকে দেখে ফেললাম এখন আমি লিখবো কী করে। কল্পনার ঘর তো ফাঁকা হয়ে গেল।
ইচ্ছে করলেই আপনি পারবেন। দেখবেন থইথই আগের থেকে অনেক বেশি দখলে চলে আসবে, আপনার ইচ্ছের সাথে সেও দুলবে।
আবার দেখা হবে বলে মালিহা কবির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে। যদিও বলে এসেছে খুব শীঘ্রই আরেকবার ফিরে আসবে কবির গ্রামে। এইটুকু মিথ্যে আশ্বাস তাকে দিতে হয়েছিল। কবির আয়ুষ্কাল আর মাত্র ছয় মাস। কম বেশি অনেক কিছুই হতে পারে। আগামীকাল মালিহা স্বামীর সংসারে চলে যাবে অস্ট্রেলিয়া। এই প্রথম যাচ্ছে। হয়তো মাঝে মাঝে ফিরে আসবে দেশে। তখন শুধু কবিতা থাকবে। কবি থাকবেন না। আসার আগে যখন কবিকে বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করে এলো তখন কবির কানে কানে বলে এসেছে ‘আমিই তোমার থইথই। আশা করছি তুমি ভালো হয়ে যাবে। তোমার কাছেই ছিলাম কবি। তুমি দেখতে পাওনি তাই আসতে হলো। এই স্পর্শটা দরকার ছিল।
কবি তার কবিতার দুটো লাইন পাঠ করলেন।
লাভার মতো একদিন মিশে যাব চুম্বনে
অরূপ আশ্রয় থইথই সম কবি হৃদয়ে।
স্কারবোরো, কানাডা