
২ জুলাই ছিলো ভাষাবিদ জামিল চৌধুরীর জন্মদিন। ১৯৩৪ সালের এই দিনে তিনি কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন, সে অনুযায়ী তিনি ৯০ বছরে পদার্পণ করলেন। এখন আছেন কানাডার টরেন্টো শহরের ৫৩৭ ফিন্স এভনিউ ওয়েস্টের একটি আভিজাত্য ওল্ডহোমে। চমৎকার সেই ‘বৃদ্ধবাড়ি’ তথা বৃদ্ধাশ্রম। তবে বাংলাদেশের বৃদ্ধাশ্রম আর কানাডার ওল্ডহোম আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
গত ৩১ মে আমি শিহাব শাহরিয়ারকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর কাছে, চকচকে, ঝকঝকে সেই প্রবীণ নিবাসে। পাঁচ তলায় তাঁর জন্য দু’টি ছিমছাম কক্ষ। একটি বেডরুম; আরেকটি সামান্য ফার্ণিসার আর দুই পাশের দেয়াল জুড়ে তাক ভর্তি নিজের লেখাসহ দেশি-বিদেশি বই ।
আমাদের যাওয়ার একটি উদ্দেশ্য ছিলো। বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব কানাডার একটি মহৎ উদ্যোগ ছিলো- কানাডায় অভিবাসী যারা জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার (বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং একুশে পদক) পেয়েছেন, তাঁদের সম্মান জানানো।
নিভৃতচারী জামিল চৌধুরী সব সময় নীরবে থাকা মানুষ। আয়োজক কবি মৌ মধুবন্তীকে জামিল ভাইয়ের কথা বল্লাম। মৌ শেষ পর্যন্ত আমাকেই দায়িত্ব দিলো।
ফোনে জামিল ভাইকে বিষয়টি জানাতেই হাসি মুখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন এবং আসার জন্য পাঁচ তলা থেকে নেমে নিচে অপেক্ষা করছিলেন। আমরা ওভার নিয়ে গিয়ে দেখি, শরীরটা ক্লান্ত লাগায় হুইল চেয়ারে উপরে উঠে গেছেন। আমরা তাঁর নিবাস কক্ষে গেলাম।
দেখলাম ওল্ডহোমে তাঁর পরিচ্ছন্ন নিঃসঙ্গ জীবনযাপন। তাঁর একমাত্র মেয়ে অহনা নিয়মিত যত্ন-সেবা তত্ত্বাবধান করেন। কিন্তু তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি অসুস্থ। স্মৃতি কিছুটা এলোমেলো। আমরা যতক্ষণ ছিলাম, তিনি বিছানায় শুয়েই ছিলেন। কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যে ঘুমিয়ে পড়ছিলেন। আবার চোখ মেলে তাকাচ্ছিলেন! কথা বলার ধারাবাহিকতা ছিলো না। মনে করতে পারছিলেন না যে, তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং একুশে পদক পেয়েছেন।
তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তাই নাকি!
জামিল ভাইয়ের কাছে যাবার আগে একটু অনলাইনে খোঁজ খবর নিলাম। বাংলা উইকিপিডিয়ায় তাঁর একুশে পদকের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্তির উল্লেখ নেই, নেই জন্ম তারিখও। অধিকাংশ বাংলা উইকিপিডিয়ায় তথ্যে নেই বা আংশিক অথবা ভুল তথ্য!
জামিল ভাই আমাদের সাথে মাঝে মাঝে খুব গুছিয়ে প্রমিত বাংলায় কথা বলছিলেন, মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছিল্ন। এক পর্যায় আফসোস করে করে বললেন, ‘যে ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছি, সেই ভাষার মুক্তি এখনো হয়নি‘।
আরো বলেন- আমরা ভাষা মুক্ত করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি। এখন তা রক্ষা করা তোমাদের দায়িত্ব।
আমাদের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার এই কীর্তিমান বাঙালি, মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম মহাপরিচালক জামিল চৌধুরী ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১৪ সালে একুশে পদক অর্জন করেন।
উল্লেখ্য, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ কৃতিত্বে এম. এস-সি পাশ করে বেশ কিছুকাল ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনা দিয়ে কর্ম জীবন শুরু করেন। পরমাণু শক্তি কমিশনে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯২ সালে সরকারের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি মাঝে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ছিলেন।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে- আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা বানান অভিধান, বানান ও উচ্চারণ, ব্যবহারিক উচ্চারণ অভিধান প্রভৃতি।
আমরা কুড়ি মিনিট ছিলাম। কিন্তু তিনি উঠে বসতেই পারছিলেন না। ইতোমধ্যে তাঁর মেয়ে অহনা এলেন ছেলেকে নিয়ে। নাতিকে পেয়ে জামিল ভাই চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। কিন্তু প্রবল ইচ্ছে থাকা স্বতেও ৩১ মে টরন্টোস্থ বাংলাদেশ সেন্টারে অনুষ্ঠিত সেই অনুষ্ঠানে তাঁর আসা হলো না। আমরা ফিরে আসার আগে শিহাব কিছু কথা রেকর্ড করেলো। কিন্তু তার বলতে কষ্ট হচ্ছিলো। বার বার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলেন!
আমিও এক ঘোরে এক অদ্ভূত তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে জামিল ভাইয়ের নীল শয্যায় স্থলাভিষিক্ত হচ্ছিলাম!
টরন্টো, কানাডা