3.2 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, মার্চ ১৩, ২০২৫

কোরবানি

কোরবানি
কোরবানি

টরন্টো যাচ্ছি আমার বন্ধু আর কাজিনদের কাছ থেকে কোরবানির গোশত জোগাড় করতে। বন্ধু কনফার্ম করেছে আসার আগে। আর বোন দু’জন ঈদের আগে বলেছিল আমার ভাগ ফ্রিজে রেখে দিবে। কেজি দশেক কালেকশন হবার কথা..

ভোরে রওনা দিয়ে বন্ধুর বাসায় পৌঁছুলাম সকাল দশটায়। সাথে সাথে আমাকে টান দিয়ে নিয়ে গেলো কসকো দোকানে। তার আগে জিজ্ঞেশ না করেই টিম হর্টনস ড্রাইভ থ্রু থেকে কফি আর ডোনাট কিনে আমার হাতে দিয়ে বলল- আপাতত এগুলা দিয়ে চালা। দুপুরে ভালোমতো খাস।

- Advertisement -

তার অনেক তাড়া। লেট হবে দেখে আমার পছন্দের মেনু নিলো না। তাছাড়া গাড়ি থেকে নামলে যদি আমি বাথরুমে ঢুকি!

কসকো তে প্রচন্ড ভীড়।

দুপুরে তার এসোসিয়েশন এর বার্ষিক বনভোজন, তাই বাজার করবে। আমি ট্রলি নিয়ে তার পিছ পিছ ছুটছি। সে অর্গানাইজইং কমিটি তে আছে, স্পনসরও করছে। তার দায়িত্বে পানি, সফ্ট ড্রিঙ্কস, তরমুজ। ওগুলো নেয়া হয়ে গেলেও সেই আধা ঘন্টা ধরে বলে চলেছে চল বের হই; আবার নিজেই হঠাৎ ব্রেক করে থেমে বলছে, একটু দাড়া তো..। কি জানি খুঁজে দেখছে, প্রাইস চেক করছে। অথচ আমি যদি একবার কোনো জিনিসের দিকে তাকিয়েছি ভাই রে ভাই, এমন ভাবে চোখ রাঙাবে যেন বাইডেন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ভাসা হারিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এর জোকারি দেখছে!

পরে আবার বলে না বসে আমার জন্য লেট হযেছে..।

আজ তার মাংস কেনার দরকারটা কি ছিল? হালাল দেখে কিনছে ভালো কথা, কিন্তু গরুর শরীরের কোন অংশের; সেটা পনেরো মিনিট ধরে চেক করে কিনতে হবে? এরকম জটিল মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। বারোটার আগে জিনিসপত্র পিকনিক স্পটে পৌঁছানোর কথা। এখন বাজে পোনে বারো। কখন পৌঁছাবো, কখন খাবো?

বিল পে করে বের হবার সময় গেইটের চেক পয়েন্টে এক মহিলা পারচেজ রিসিপ্ট দেখতে চাইলো। ওটা আমার পকেটেই ছিল। কিন্তু এখন সারা শরীর তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পেলাম না। চিশতী দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো- ভালো করে খোঁজ হারামি! তার ফোনে অনবরত কল আসতে থাকে- পানি, ড্রিংকস কোই? গেস্ট সব চলে এসেছে..

রিসিপ্ট খুঁজে পাওয়া গেলোই না।

আমরা গেইটে আটকে গেলাম। ওয়্যারলেসে কর্মী ডাকা হলো। সে আসলো পাক্কা দশ মিনিট পর, গড়িয়ে গড়িয়ে। বন্ধুর মেম্বারশিপ কার্ড নিয়ে বলল- নতুন রিসিপ্ট প্রিন্ট করে আনছি, অপেক্ষা করেন। ভদ্রমহিলা গো টু গো এমনভাবেই গো, আর ডিড নট কাম। পঁচিশ মিনিট পর সমুদ্রে ঝড়ে জাহাজ দুলবার মতো করে এসে, রিসিপ্ট এনে এমন ভাব দেখালো; যেন জন্মের উপকার করে ফেলেছে।

পিকনিকে আমাকে ভলান্টিয়ার বানিয়ে দিয়ে বলল- তরমুজগুলা কাট। চা সিংগাড়া খেয়ে খাবার সার্ভ করে শেষ ব্যাচে বসবি। অনেক খাওয়ার বাঁচবে, যত খুশি নিয়ে যাস।

পেটে খিদে নিয়ে শত শত মানুষকে খাওয়ানো যে কত কঠিন, সেটা কে বুঝবে? সামনে পোলাও, খাসির রেজালা, গরু, সবজী, মুরগী, কাবাব, টিক্কা, আচার, ড্রিংকস ইত্যাদি। কচকচে চর্বিযুক্ত খাসির সিনা নিজে না নিয়ে অন্য কে বিতরন করতে হচ্ছে। হঠাৎ মাইকে এনাউন্স করে সে আমাকে ডেকে আনলো। আমি ভাবছিলাম লটারিতে প্রেসার কুকার জিতছি। আমার হাতে তার বাসার চাবি দিয়ে বলল- রিপন রে, তোকে কষ্ট দিবো। ওয়েফেয়ার থেকে ফার্নিচার আসছে, বৃষ্টি আসলে বিপদ। দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে। তুই গিয়ে রিসিভ কর, বলবি ঘরে যেন ঢুকিয়ে সেট করে দেয়। আধা ঘন্টাও লাগবে না। এসে খাস, তোর জন্য সবকিছু আমি তুলে রেখে দেব।

আমি ছুটলাম তার বাড়ির দিকে।

ওয়েফেয়ারের লোক দুজন বিরাট প্যাকেট ঢুকাতে না পেরে দরজার স্ক্রু খুলে তারপর ঢুকালো। তারপর বিশাল কাঠের আলমারি সেট করতে লাগলো দুই ঘন্টা ধরে, তাও ফিনিসিং না দিয়ে চলে গেল। আমি আর পিকনিকে ফিরে যাইনি। চিশতী সন্ধ্যার আগে কিছু বেঁচে যাওয়া খাসির ঝোল, সালাদ আর এক গাদা পোলাও এনে দিল। কোনোরকমে খেয়ে জীবন বাঁচাই।

পরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে কেবল চা শেষ করেছি, ওমনি ডাক দিয়ে বলল- চলতো কাজ করি; গ্যারেজটা সাফ করি। তুই শীতকালে এখানে এসে পার্কিং পাস না, কতো কষ্ট করে রাস্তায় পার্ক করিস! কতবার টিকিট খাইছিস!

আমরা দু’জন গ্যারেজ থেকে টানাটানি করে গাড়ির পুরানা টায়ার, বিশাল কাঠের টেবিল, টনখানেক হাবিজাবি বের করে বেইজমেন্টে নামাতে থাকি। সব কাজ আমিই করলাম, সে শুধু নির্দেশনা দিয়েই খালাস। আজ প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরমে ঘেমে গোসল। এ কাজ শেষ হলে সে আমার মাজায় দড়ি বেঁধে ছাদে তুলে দিলো তার সোলার প্যানেলগুলো মুছাতে । ভালোমতো নাকি বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। প্রায় চল্লিশ বর্গফুটের তিনহাজার ওয়াটের প্যানেল!

তারপর ডাউনটাউন দেখানোর নাম করে বিকালে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেলো সানিব্রুক হসপিটালে। তার এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়’র রক্ত লাগবে। আমি শিওর সে তাকে ভালোমতো চিনেই না। আমার কাছ থেকে দুই ব্যাগ রক্ত নিলো। তারপর পাঁচ মিনিটের একটা লেকচার দিলো রক্ত দেয়ার উপকারিতা সম্পর্কে। ফিরবার সময় গরীবে নেয়াজের বিরিয়ানি আর জুস কিনে আনলো।

পরদিন সকালে তার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় বলল- রিপন রে, লজ্জায় পড়ে গেলাম

– কেন?
– তোর জন্য রাখা গোশত সব শেষ, এত দূর থেকে আসলি..
– ব্যাপার না
– আমেরিকা থেকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসছিল। রান্না করে ফেলছি। ছোয়াব অবশ্য হলো সব তোর। তোর মাংসই খাওয়ালাম
– ভালো করছিস
– তুই এই কসকোর মাংসের প্যাকেটটা রাখ।- বলে গত পরশু কেনা মাংসের প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিলো।

[** কসকো’র মাংস অটোয়া নিয়ে এসে পড়েছিলাম আরেক ফাঁপরে। হাড্ডিসহ তিন কেজি মাংসের আস্ত দলা কাটতে কিনতে হয়েছিল নব্বই ডলারের ইলেকট্রিক করাত। বউকে বলেছিলাম কোরবানির গোশত। ওদিকে দোকানের সিল তুলতে ভুলে গিয়েছিলাম..। সেই দুঃখের কাহিনী আরেকদিন বলবো]

দুপুরের আগে অটোয়া ফিরবার আগে মামাতো বোনের বাসায় দেখা করতে গেলাম। পাশের পাড়া থেকে খালাতো বোনও দৌড়ে আসলো কোরবানির মাংসের পুটলি হাতে। তাদের অনেক অভিযোগ আর অভিমান; কেন তাদের আগে জানাইনি এতো দুর এসে।
আমার মামাতো বোনের এলাহী কারবার।

সে নিজে রান্না করে না, সব আসে ক্যাটারিং থেকে। তার ঘর-দূয়ার সাফ করে দিয়ে যায় পরীর মতো সুন্দরী একঝাক ফিলিপিনো। প্রতি সপ্তাহে। বাগানের পার্টটাইম মালি আছে। পার্ট টাইম অন কল গাড়ির ড্রাইভারও রাখা। বিমানের পাইলটের মতো ড্রেস পরে থাকে গম্ভীর মুখে।
আজ দুই বোন মহা আনন্দে মাংস রান্না শুরু করে দিলো বাংলাদেশ থেকে আনা বিরাট মাটির হাঁড়িতে। আমার দায়িত্ব কুড়াল দিয়ে কাঠ কাটা। সারা অশোয়া শহর রটে গেল। তাদের বন্ধু-বান্ধবে ভরে গেল। দুই বোনের অনুরোধে বিশাল নাসপাতি গাছটায় চড়ে পেরে দিতে হলো মন খানেক নাসপাতি। গাছ থেকে নামার সময় পড়ে ডান হাতের বাহু ছিলে হলো রক্তারক্তি অবস্থা। এমনিতেই রক্ত কম..

ভাগ্য ভালো হাতটা ভাঙেনি।

আমার জন্য বরাদ্দ কোরবানির মাংস দিয়েই হয়েছে পিকনিক..

বিদায় নেবার সময় বোন একটা বক্সে তিনটা পরোটা আর কয়েকটুকরো গরু ভুনা ভরে দিল; রাস্তায় খিদে লাগলে যেন খাই।

গাড়ি স্টার্ট দিতেই কড়া কিন্তু ঠান্ডা গলায় গিন্নীর ফোন, চান্দু!

– এই যে আসতেছি। রওনা দিসি..

– কোনো দরকার নাই. ওখানেই থাকো। পরশুদিন আসার কথা তোমার। বাসায় এক ফোটা বাজার নাই। ওখানে কি মধু আছে? আর শোনো, নেক্সট টাইম আর একবার যদি তুমি টরন্টো গেছো, আমরা ধরেই নিবো ওখানে তোমার আরেক সংসার আছে..

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles