
এ ভাবেও ফিরে আসা যায়। কী আর বয়স এমন। তুমি তো সবার ছোট। ছোট মানে ছয় জনের পর সাত। কত মানুষ যুদ্ধে গিয়ে বোমার আঘাতে ছেঁড়া নাড়ি নিয়ে ফিরে এসেছে। কত মানুষ মারাত্মক রোগের সাথে ঘর বেঁধে লিখে ফেলেছে বড় বড় উপন্যাস, করেছে মহান সব আবিষ্কার।
কে কখন বুক টান করে দাঁড়িয়ে উঠবে সেটা সে নিজেও জানে না। জানে শুধু তার নিজের ভেতর বাস করা অন্য একটি ছায়া মানুষ। এখন তোমার কাজ হলো সেই ভেতরে বাস করা যোদ্ধা মানুষটাকে শিরস্ত্রাণ পরিয়ে প্রস্তুত করা।
তোমার নামের সাথে চঞ্চলতার ইঙ্গিত আছে। অথচ আমি কখনো তোমাকে চঞ্চল হতে দেখি নি। চুপচাপ অন্যের কথা শোনার প্রতি অন্য রকম ভঙ্গি দেখেছি। খুব মনোযোগ দিয়ে কথা শুনতে পার তুমি, চোখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত চুপচাপ অপেক্ষা। তাই বলে রাগ নেই তা নয়, রেগে গেলে তো ফাঁকা মাঠে হ্যাট্রিক।
এগুলোই একজন মানুষের প্রতি অন্য মানুষের আকর্ষণ। একের কাছে অন্য মানুষের আপন হয়ে ওঠার অবলম্বন। যেমন পত্র পল্লবে অমিল, তেমনি প্রতিটি মানুষই ভিন্ন। কেউ কারোর মতো নয়। জানো হয়তো, আমাদের অনেক আদরের তুমি। সবচেয়ে বড় কথা হলো তোমার মায়ের নেক নজরের ছিলে তুমি। ঐ যে বললাম ছয়ের পর সাত তবুও তোমার নম্বর ছিল ওয়ান। তুমি যা চাইতে শাশুড়ি মা ঠিক ঠিক নিয়ে আসতো তোমার কাছে। কখনো সবার সামনে, কখনো গোপনে। এর নাম অর্থবহ ভালোবাসা। কাজেই মায়ের আশীর্বাদ আছে তোমার মাথার ওপর।
তোমার মেয়েটি যখন জন্ম নিলো তখন প্রায় বলতে আমার মা, সাক্ষাৎ রিজিয়া বেগম। নিজের মেয়ের গালে চুমু খেলে মনে পড়ে যেত কেমন করে তোমার মা তোমাকে আদর করতো। সেই মেয়ে এখনও অনেক ছোট। বড় হবার মধ্যে শুধু এতটুকু বড় হয়েছে যে তোমার হুইল চেয়ারটা ঠেলতে পারে। গোল ডাইনিং টেবিলটাকে কেন্দ্র করে তোমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর মনে করে যেন বাবার সাথে রেলগাড়ি খেলা করছে। এই যে ছোট্ট মেয়েটির সাথে তোমার নিবিড় সান্নিধ্য সেটাও একটা শক্তি। এই শক্তি তোমাকে সুস্থ করে দিতে পারে অনেকখানি।
আমি যুদ্ধ করেছি। তাই নিয়ে তোমার অনেক আগ্রহ ছিল। আমার বিয়ের পর জানতে চাইতে যুদ্ধের নানান কথা। প্রবাসে এসেও ফোনে তোমার সাথে যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছি অনেক। আমার সাথে কথা বললে তোমার বুক উঁচু হয়ে যেত সেটা বুঝতে পারতাম। কেননা তুমি মুক্তিযুদ্ধ এবং যোদ্ধাদের খুব বড় করে দেখতে শিখেছ। দেখ চপল, যুদ্ধ হয় শত বছর পর একবার কিংবা দুইবার। অথবা জীবদ্দশায় অনেকে কোন যুদ্ধ না দেখে চলে যায়। অথচ আমাদের ঘরে ঘরে যুদ্ধ চলে অবিরত। তোমার ঘরে এখন দুশ্চিন্তার যুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধে তুমি একজন সাধারণ সৈনিক।
তারামন বেগমের মতো তোমার স্ত্রী অর্থাৎ আমার শ্যালক বধূ টগর, প্রধান সেনাপতি। এমন একজন সেনাপতির তত্ত্বাবধায়নে তুমি নিরাপদ আছ সেটা বলতে পারি। তা ছাড়া তোমার চারটি বোন রাতদিন তোমার জন্য হাত উঁচিয়ে দোয়া করে যাচ্ছে। বড় ভাই নিজে অসুস্থ অবস্থায়ও তোমার খোঁজ খবর নিচ্ছে সারাক্ষণ, মাত্র এক সপ্তাহ আগে তার ওপেন হার্ট সার্জারি হলো। বাদল তো এখানে ওখানে বসে চোখ ভিজিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। ওর শরীরটাও তেমন ভালো কোথায়। সমস্ত আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব, কর্মস্থানের লোকজন তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা তোমার অর্জন।
এটা তোমার পিতা আব্দুল মালেকের প্রতি সকলের ভালোবাসার নিদর্শন। বেশ কিছুদিন ধরে তোমার ছোট আপা, যাকে তুমি রোজী বলেই ডাকো সে কাজে মন বসাতে পারছেন না। সারাক্ষণ তোমার ভিডিও ক্লিপ দেখে অথবা টগরের পাঠানো ছবি দেখে দেখে চোখ ঝাপসা করে বসে থাকে। আমি ওকে বলি, দেখবে চপল ফাইট করতে পারবে। যুদ্ধ ও যোদ্ধাদের সম্পর্কে ওর যথেষ্ট জ্ঞান আছে।
কাজেই এভাবেও ফিরে আসা যায়। অনেকই ফিরে এসেছে। বলতে গেলে এটা এমন কোন কঠিন কিছু না। তুমি শুধু প্রস্তুত হও, একটি দানবের সাথে তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে। তোমার ছেলে, তোমার স্ত্রী এবং শিশু কন্যাটি তোমার সাথে আছে রণাঙ্গনে। তোমার ছোটবেলার একটি ছবি আছে আমাদের কাছে। পরিবারের সবাই এক সাথে। সেই ছবিতে তোমাকে যেমন দেখায় তোমাকে সেভাবেই এখনো দেখি। আমাদের ছোট্ট চপল। জানি না তোমার কাছে এই ছবিটি আছে কিনা। তোমার সম্পূর্ণ সুস্থতা এখন আমাদের একমাত্র প্রার্থনা।
স্কারবোরো, কানাডা