
ক্লাস ত্রি’র ছাত্র আমি।একদিন সকালে আব্বার সাথে যশোর থেকে খুলনা এলাম।খুলনা শহর তখন ছোট খাট। পাশ ঘেষে ভৈরব নদী, নিকটেই আদালত ভবন।হেলিপ্যাড অনতিদূরে।মাঝে মাঝে হেলিপ্যাড দেখতে নিতেন। হেলিকপ্টার সার্ভিস ছিলো এক সময় ঢাকার সাথে।
তখন ঢাকায় যাওয়ার জন্য পরিবহন ব্যবস্থা তেমন গড়ে ওঠেনি।ষ্টীমারই একমাত্র ভরসা ছিলো খুলনাবাসীদের। সেদিন সকাল ন’টায় আব্বা এলেন আদালত ভবনে। তার এক বন্ধু ছিলেন জাজের পেশকার।তার সাথে দেখা করবেন।আদালত ভবনের দরজা কেবল খোলা হচ্ছে।
ঝাড়ুদাররা পরিস্কার করছেন।শুনশান পরিবেশ চারিদিকে। আব্বার সাথে হাঁটছি। আব্বা একটা বিশাল কক্ষে ঢুকে দেখেনিলেন।বললনে তাঁর বন্ধুকে এখানে পাওয়া যাবে।ভেতরে কেউ নেই, সারি সারি আসন পাতা। চেয়ার বেন্চি মিলিয়ে বেশ কয়েক সারি।উচু স্থানে টেবিল, তার পিছে লাল কাপড়ে মোড়া বড় চেয়ার। আমি দেখছি।আব্বা দেখালেন-ওখানে জাজ বসেন, ওখানে পেশকার ——-।
দরজার কাছে আমরা দুজনা দাঁড়িয়ে এসব দেখছি।হঠাৎ দূরের লাল আসনটি(জাজের আসন) দেখিয়ে বললেন-যা ওখানে গিয়ে একটু বসে আয়। -কেউ কিছু বলবে না?আমি জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন-না, কেউ তো নেই।আমি এখানে দাঁড়িয়ে দেখছি।কেউ আসবে না। ভয় মিশ্রত অনুসন্ধিৎসা নিয়ে আমি সামনে যেতে থাকি আর পিছু ফিরে আব্বাকে দেখি। আব্বা এদিক ওদিক তাকিয়ে আমাকে অভয় দেন।
এক সময় লাল চেয়ারটার কাছে পৌঁছে গেলাম, চেয়ারটায় বসলাম।আব্বা পূর্বের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে আমাকে অভয় দিলেন যেন কেউ নেই আশেপাশে। কিছুক্ষন বসে থাকলাম।এবার ইশারায় আমায় চলে আসতে বললেন।আমি তাঁর কাছে ফিরে এলাম।এই স্মৃতি আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
১৯৮৮ সালে আব্বা মারা যাওয়ার পর একদিন ভাবছিলাম তাঁর সাথে আমার কিকি স্মৃতি জড়িয়ে আছে।এরকম এক মুহুর্তে আমার মনের মধ্যে খুব অস্পষ্ট কোন কিছুর ছবি ভেসে উঠেছে যেমনটি নদী বা পুকুরে ঘোলা পানির নীচের বস্তু একসময় পরিস্কার দেখা যায় ঠিক তেমনি।
আমাদের বাবারা আমাদের নিয়ে কতো ভালো চিন্তা করেন। সবার কামনায় থাকে তার সন্তান যেন অনেক বড় হয়। ভালো কোন পদে অধিষ্ঠিত হয়।জীবনের অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে হয়তো আমরা কাঙ্খিত কোন একস্থানে পৌঁছাই ঠিকই কিন্ত্ত অল্প বয়সে অনেকেই হারিয়ে ফেলি বাবা-মাকে। আমরা রয়ে যাই মরা গাছের অপ্রস্ফুটিত কুঁড়ির মতোন।
ইয়েলোনাইফ, কানাডা