16.1 C
Toronto
শনিবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৫

বন্ধ হোক রক্তক্ষয়ী সংঘাত

বন্ধ হোক রক্তক্ষয়ী সংঘাত - the Bengali Times
বন্ধ হোক রক্তক্ষয়ী সংঘাত

পেশাগত কাজে, অর্থাৎ কোম্পানির বার্ষিক সম্মেলন ২০২৪ এ যোগ দিতে চার দিনের জন্য ভিক্টোরিয়া (বি সি) শহরে গিয়েছিলাম। মোটামুটি নির্জন একটি দ্বীপ। না ছিল সোশাল মিডিয়াতে ঢোকার সুযোগ, না ছিল পরিবারের সাথে যোগাযোগের সময়। শুধু ভালো আছি ভালো থেকো, এইটুকুই। ব্যাক টু ব্যাক জ্যাম কর্মসূচি। গতকাল প্লেনে ওঠার জন্য ভিক্টোরিয়া এয়ারপোর্টে বসে ফেসবুক খুলতেই দেখি, দেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত এবং অগ্নিশর্মা সোশাল মিডিয়া। দুঃখজনক যা ঘটেছে তা হলো অনেক প্রাণ ঝরে গেছে। অনেক মায়ের কোল খালি হয়ে গেছে। সংখ্যাটা বেড়েই যাচ্ছে। গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি মৃতদের পরিবারের প্রতি। আমিও চাইছি, অবিলম্বে বন্ধ হোক রক্তক্ষয়ী সংঘাত। সংগত কারণেই সোশাল মিডিয়ার প্রশ্নগুলোর ধরণ এক নয় বরং বিবিধ।

আমাদের ছাত্র জীবনে পরীক্ষার খাতায় সাধারণত দশ বারোটি প্রশ্ন থাকতো। কোন প্রশ্নই দুই এক লাইনের বেশি নয়। কিন্তু উত্তর দিতে সময় দেওয়া হতো দুই কিংবা তিন ঘণ্টা। যদিও প্রস্তুতির জন্য এক বছরের বেশি সময় পাওয়া যেত। বলতে চাচ্ছি, প্রশ্ন করা খুব সহজ। উত্তর দেওয়া কঠিন এবং উত্তরের মধ্যে ভুল থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তাই এই মুহূর্তে কঠিন কে সহজ করার কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। মধ্যরাতে বাসায় পৌঁছে একটা ঘুম দিয়ে উঠেই দেখি উত্তেজনা অধিকতর চরমে।

- Advertisement -

মাত্র কয়দিন আগে লিখেছিলাম ‘ভাবছি কলমটি বেচে দেব’। লিখেছিলাম, যাহা সত্য তাহাই বিশ্বাস। এমনই ব্রত নিয়ে ছুটেছিল আমার কলম বিলাস। আজও বলছি, আমার কলমে এমন কোন দুর্বলতা নেই যে এক কথায় কোন প্রশ্নের মাঝে লুকানো বিষ পান করে ফেলবো। আবার এমন কোন শক্তিও নেই যে এক কথায় হাজার হাজার বুকের আগুন নিভিয়ে দিতে পারবো। তবে, আমি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। বলতে পারেন তাঁর থেকে বড় হিমালয় দেখা আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হয় নি, এই দুর্বলতার কারণে এখনও বঙ্গবন্ধুকে বটবৃক্ষ মনে করি। রাজনৈতিক কিংবা রাষ্ট্রের দ্বিধা দ্বন্দ্বে তার শরণাপন্ন হই।

একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ করেই আমি হাত উঠিয়ে বসে থাকি নি। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং সময়টাকে বুকের গভীরে লালন করি। বলতে পারেন সেটাই আমার হৃদপিণ্ড। অনেকে যেমন শুধু বাংলাদেশকে ভালোবাসেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে নয়। আমার মধ্যে আর তাদের মধ্যে এইটুকুই তফাত। মুক্তিযুদ্ধকে বাদ দিয়ে আমি বাংলাদেশকে ভাবতে পারি না। হোক সে তেপ্পান্ন বছর আগের ইতিহাস। সে কারণে যে যখনই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে বিষ বাষ্প ছড়িয়েছে, আমি তাকে দুঃখ ও করুণা মিশিয়ে দেখেছি। অনেক ক্ষেত্রে ঘৃণাও করেছি। অন্যদিকে যিনি মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও সুফল নিয়ে কথা বলেছেন, আমি তার সান্নিধ্য কামনা করেছি। বর্তমান পরিস্থিতিতেও আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গরিলা। যে একবার মুক্তিযোদ্ধা সে আমৃত্যু মুক্তিযোদ্ধা। কারোর ইঙ্গিত পূর্ণ কথাকে সায় দিয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধের অনুভূতিকে ছোট করে দেখবো না। সে যতোই কাছের কিংবা দূরের মানুষ হন না কেন। আশার কথা হলো প্রবাসে এসেও আমার নিজস্ব চেতনা থেকে দ্বিগুণ-বহুগুণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালন করা মানুষ পেয়েছি এবং তাদের সাথে এখনো ছায়ার মতো লেগে আছি। তারাই আমার আলো ঘর। যদিও মাঝে মাঝে দেখি ভুল মানুষটির পাশে দাঁড়িয়ে আছি। হতেই পারে।

আমি বিশ্বাস করি যেভাবে মাতৃভূমি আজ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেল তা আদর্শগত বিভক্তি নয়। অনুশোচনা ও সহানুভূতির বিভক্তি। কোনভাবেই কোন অন্যায় অনাচার অবিচার দুর্নীতিকে বিবেকবান মানুষ মেনে নেয় না। অন্যায় হলে প্রতিবাদ হবেই। কেউ সম্পূর্ণ অংশকে একক করে নিলে প্রতিবাদ আসবেই। কেউ লাগামহীন হয়ে উঠলে তার দিক থেকে সমর্থন সরে যাবে এটাই স্বাভাবিক। আমি কাউকে পরামর্শ দিতে চাই না। সে ক্ষমতা আমার নেই। আমি শুধু আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারি। দেশ শান্ত হবে। শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রতি কাজ করার জন্য যথেষ্ট সদিচ্ছা বর্তমান সরকারের আছে। কিন্তু… না না কিন্তু নয় হয়তো বলা উচিৎ ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি হয়, তাঁর ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব’। এই কথাটি আমার নয়, বঙ্গবন্ধুর কথা। উল্লেখ্য, তিনি বলেছেন ‘আমারা মেনে নেবো’। তিনি কিন্তু ‘আমি’ বলেন নি। এখানেই তিনি বঙ্গবন্ধু, এখানেই গণতন্ত্রের ইশারা। এখানেই ন্যায্যতা। কথাটি সকল সময়ের জন্য প্রযোজ্য। আশা করি আমাদের সরকার প্রধান সেটা মেনে চলবেন।

আমি বিশ্বাস করি দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ন্যায্য সমাপ্তিতে বিশ্বাসী। আমি আশাবাদী তাঁর মুখকে যারা ইয়াহিয়ার মুখের উপর বসিয়ে প্রচার করছে তারা অচিরেই বিশ্বাস করবে দেশের যুব সমাজের প্রতি তাঁর সম্পূর্ণ আস্থা আছে। অতীতেও বিদ্রোহীরা তাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেছে। তবুও বলছি, বর্তমান সরকার প্রধানের দুর্বলতা অনেক, তিনি তোষামোদিদের দূরে রাখেন না। তিনি সঠিক উপদেশ পাচ্ছেন না অনেক ক্ষেত্রে। কালো শাড়ি পরে টেলিভিশনে উপস্থিত না হয়ে বুকে কালো ব্যাজ পরা যে অধিকতর বাস্তবসম্মত হতো এই পার্থক্য তিনি করতে পারেন না। কাজেই যে ব্যক্তি কালো শাড়ি পরে সমবেদনা জানাতে পরামর্শ দিয়েছে তাকে তিনি শাস্তি দেবেন না। যে নিরস্ত্র যুবকের বুকে গুলি ছুঁড়েছে সেই পুলিশকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে তিনি হয়তো বিলম্ব করবেন। তাঁকে বুঝতে হবে সময়ের এক ফোঁড় বিশেষভাবে জরুরী। আমেরিকা, রাশিয়া, চিন ভারতের গুটি চালার প্রতি তিনি তীক্ষ্ণ নজর রাখলেও তাঁর পিয়নের চার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যাওয়াকে তিনি নজরদারীর মধ্যে রাখতে পারেন না। যারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান না, তারা যে সবাই রাজাকারের সন্তানও না এই বিভাজনে তিনি ভুল করে থাকলে ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া দোষের কিছু না, বরং সেটাই কাম্য। ‘আমার কথায় যদি কেউ দুঃখ পেয়ে থাকেন বা ভুল বুঝে থাকেন তবে আমি দুঃখিত’ এমনটা বলতে আজকাল কেউ দেরি করে না। জানি না তিনি এমনটা এখনও করেছেন কি না। কাজেই তাঁর প্রচুর ভালোর নিচে কিছু অন্ধকার থেকেই যাচ্ছে। বলা হচ্ছে আন্দোলনকারী ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির প্রবেশ দৃশ্যমান হয়েছে। এমন কথা বায়ান্ন উনসত্তরের আন্দোলনের সময়ও শোনা গেছে। যেমন, ‘কমিউনিস্টরা আন্দোলনকারীদের মদত দিচ্ছে’। অনুপ্রবেশকারীরা থাকবেই তাতে মূল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য এক সময় একটি স্লোগান লিখেছিলাম। লেখাটি তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সংক্রান্ত। তাতে বলেছিলাম ‘বোন তুমি এগিয়ে চলো, আমরা তোমার কামাল জামাল’। আমার স্লোগান তিনি শুনতে পান নি ভালো কথা কিন্তু পরবর্তীতে দেখেছি তাঁর চোখে দেশের সব যুবকই জামাল কামাল। কাজেই তাঁর নিকট থেকে কোন আঘাত অথবা অপমান আসলে তা মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এটাও তাঁর মনে রাখতে হবে। এই সর্তক কেউ তাকে করতে পারে নি। কাজেই অতীতে তাঁর কিছু কথার মতো এবারো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে প্রকাশ ভঙ্গি। যা মন্দ তাকে উচ্চারণ না করে ভালোর মধ্যে থাকাই উত্তম পন্থা, এটা জানাও জরুরী দেশ ও সরকার প্রধানদের। কেননা তিনি দেশের সবার আস্থার যায়গা।

পরিশেষে বঙ্গবন্ধুর কিছু প্রাসঙ্গিক কথা তুলে ধরতে চাই।

‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি’

‘দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে’

‘যে ভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে’

‘শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন’

যখনই মানুষের বুকের উপর গুলি ছোড়া হয় তখনই আমি খুলে দেখি তাঁর বাণী। বর্তমান সময়ে হাত উঁচু করে স্লোগান দেওয়া পক্ষকে বলি। আপনাদের সাথে সহানুভূতি এবং সমর্থন নিয়ে এগিয়ে এসেছে দেশের অগুনিত মানুষ। তাদের সমর্থনকে বুঝতে চেষ্টা করুন। সেটাকে কাজে লাগান সঠিক পন্থায়। ধ্বংসাত্মক হবেন না। সমর্থন দেওয়া যেমন যায় তা উঠিয়েও নেওয়া যায়। কাজেই অচিরেই যদি আপনাদের মধ্যে কেউ বাংলাদেশের সম্পদের ক্ষতি সাধনে লিপ্ত হন, বিদেশীদের দ্বারস্থ হয়ে হস্তক্ষেপ কামনায় কাকুতি মিনতি করেন, বঙ্গবন্ধুর ছবিতে আঘাত করে বসেন। অন্যের এজেণ্ডা কার্যকরী করতে কর্মসূচি নেন, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের আত্মা ও তাঁদের পরিবারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, আর যদি আপনাদের মুখ থেকে বিলাতী গন্ধ বের হয় তখন কিন্তু ফাঁকা হয়ে – ছোট হয়ে যেতে পারে মিছিলের দৈর্ঘ্য। ডান বাম দু পাশ থেকে বয়ে যাবে শোঁ শোঁ বাতাস। ফাঁকা চারিপাশ। এমনটা আমরা অতীতও দেখেছি। আর যদি সঠিক পথে থাকেন তবে স্বপ্নের বাংলায় অতীতের ন্যায্য আন্দোলনকারীদের মতো এবারও জয়ী হবেন। মনে রাখবেন, ভুলের মাশুল যেমন সরকারকে বইতে হচ্ছে সে ভার যেন আপনাদের ওপর না এসে পড়ে। পরামর্শ নয়, পাশে থেকেই বললাম।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles