
আগের চাইতে আরো অনেক বেশী বাইরের জগতের সাথে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করি। বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সংযুক্ত আছি নিজের সংগঠন আছে সেটা নিয়েও সময় কাটাই । আমরা যাযাবরদের মতো ঘুরে বেড়ানোর মানুষ । ঘুরাঘুরি না করতে পারলে মন ভালো লাগে না। সে জন্য প্রতি বছর সামারে আমরা কিছু বন্ধু মিলে চলে যাই কটেজ এলাকাতে। কয়েদিন হৈ চৈ আনন্দ উৎসব করে ফিরে আসি। খাবার করে নিয়ে যাই, সেখানেও বনভোজনের মতো রান্না বান্না করে খাই। ছেলেদের চলে মাছ ধরা। আমরা লেকের পাশে বসে ওদের মাছ ধরা দেখি। বড় মাছ ছিপে ধরা পড়লে আমরাও আনন্দে লাফিয়ে উঠি । লেকে নেমে সাতার কাটী। শহরের কোলাহল থেকে বেড়িয়ে এসে কয়েকটা দিন আনন্দে মেতে থাকা নিজেদের মতো করে ।
কটেজ এলাকাগুলো হোল ক্যানাডার গ্রাম। যাকে বলা চলে ‘ ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ । শহরের কোলাহল ছেড়ে শান্ত ছায়াতে আনন্দ করে আসা। অনেক এলাকা আছে কটেজ ভাড়া করে থাকার জন্য। কারো কারো নিজস্ব কটেজও আছে । ছুটির দিনগুলো ওরা নিজস্ব কটেজে কাটায় । আমরা বন্ধুরা মোটা মুটি সব এলাকার কটেজেই ঘুরে ফেলেছি। ছোট গ্রাম তবে সব রকমের সুযোগ সুবিধা আছে। আছে ছোট ছোট রেস্তুরা, আছে খুব সুন্দর সুন্দর বুটিক সপ। সেসব দোকানে গেলে ছোট খাটো হলেও কিছু একটা না কিনে বেড়িয়ে আসতে ইচ্ছে করে না।
এতো কটেজ এলাকাতে ঘুরেছি তারপরও কোন স্মৃতি মনের মাঝে উঁকি দেয় কখনো কখনো , আজও লিখতে বসে মনে পড়লো মেয়েটির কথা । মেয়েটি কি এখনো ঐ এলাকাতেই আছে নাকি অন্য কোথাও ? কি জানি মেয়েটি এখন কেমন আছে?
পশ্চিমের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। র্সূয্য আজকের মতো বিদায় নেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আকাশের লাল আভা লেক হিরনের পানিতে পড়ে এক অপরুপ রুপের সৃষ্টি করেছে। আমরা আজ দুপুরে এসে এখানে পৌছেছি। আমরা আঠারো জন। বিকেলে বেড়িয়েছি এখানকার লাইট হাউজ দেখতে। লাইট হাউজের পদদেশে লেক হিরনের পানি বয়ে যাচ্ছে নীরবে। লেক হিরনের গা ঘেসে শুধু পাথর আর পাথর। লেক হিরনের পানি শান্ত ছিল সে মুহুর্তে , তারপরও ছলাৎ ছলাৎ করা পানির একটা শব্দ এসে গড়িয়ে পরছে পাথরের উপর। আমরা এপাথর থেকে সে পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছি। পানিতে পা ডুবিয়ে উহু করে চিৎকার দিয়ে উঠছি। বরফের মতো ঠান্ডা পানি। ঠিক সেই সময়টুকুতে আমাদের মনে হচ্ছিল আমরা যেন আঠারো জন তরুন তরুনী আনন্দ উলাসে মেতে উঠেছি। হিরন লেকের নির্জন তীরটি আমাদের কলো কাকলিতে মুখর হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ করেই চোখ পড়লো মেয়েটির দিকে। লেকের তীরে আমাদের থেকে কিছুটা দুরে একটু উচু জায়গায় মেয়েটি বসে আছে একটি তওলিয়া গায়ে জড়িয়ে। সোনালী রঙ চুলের মেয়েটির মুখে পড়ন্ত সূর্যের আলো পরেছে ,দেখে মনে হচ্ছে কোন শিল্পী তার তুলির আচরে মেয়েটিকে নিজের মনের মাধুরী মিশেয়ে অসাধারন সুন্দরী করে তুলেছে। হঠাৎ করেই তওলিয়া সরিয়ে মেয়েটি
পানিতে ঝাপ দিল । আমি ঘাবড়ে গেলাম এই ভেবে মেয়েটি কি আত্মহত্যা করতে চায়? নাহ্ মেয়েটি পানিতে ডুব দিল না। গলা পর্যন্ত পানিতে নিজেকে ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকলো এই বরফের মত ঠান্ডা পানিতে। মেয়েটি যে পানিতে নামার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে তা বুঝতে পারলাম তার পরনে সাতারের পোষাক দেখে। মেয়েটি মিনিট পাচেক নিজেকে ডুবিয়ে রেখে আবার উঠে এলো ডাঙ্গায়। আবারও বসে থাকলো তওলিয়া জড়িয়ে। আবার কয়েকমিনিট পর পানিতে ঝাপ দিয়ে নিজেকে গলা পর্যন্ত ভিজিয়ে রাখলো। এভাবেই চলতে লাগলো মেয়েটির পানিতে নামা আর উঠা। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল মেয়েটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি ‘এই মেয়ে তুমি ভালো আছোতো? তোমার মনে কি অনেক কষ্ট? সে কষ্টটুকু পানিতে ডুবিয়ে দিতে এসেছো? নাকি এটা এক ধরনের শারীরিক ব্যায়াম যা তোমাকে সুস্থ রাখবে? তুমি কি কোন মানষিক রোগী? তুমি কেন এমন একা নির্জন বিকেলে বসে আছো এখানে কিন্তু আমার কোন কথাই জিজ্ঞেস করা হলো না। আমি মেয়েটির কাছেও গেলাম না। এদেশে কারো ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কৌতুহল দেখানোটা শোভনীয় না। কোন কোন ক্ষেত্রে সেটা হেরাছমেন্টের পর্যায়ে পরে যায়। বলা যায় না এই অপরাধে আমার বিরুদ্ধে একটা মামলাও টুকে দিতে পারে।
সূর্যের আলো প্রায় নিভে যেতে বসেছে। একটু পরেই অন্ধকার ছেয়ে যাবে পুরো এলাকাটিতে। আমরা পা বাড়ালাম কটেজের দিকে । কিন্তু তখনো মেয়েটি সে ভাবেই তার ডুবে থাকার আর উঠে আসার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আমার ফিরতে ফিরতে চিন্তা হচ্ছিল মেয়েটি কি সারারাতভর এইকাজটিই করবে, এই নিরব নিস্তব্ধ লেকের ধারে বসে?
প্রতি বছরই আমাদের এই বন্ধুর দলটি কটেজ ট্রিপে যাই। শীতের হাওয়ার নাচন বন্ধ হয়ে যখন উষ্ণ হাওয়ার মাতনে আমরা নতুন করে জেগে উঠি। গত বেশকিছু বছর ধরে কতনা জায়গায় আমরা যাচ্ছি। আমাদের এবারের ট্রিপ ছিল টোবার মুড়িতে। সেদিন ছিল ঝুম বৃষ্টি। অঝর ধারার বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমরা আঠারোজন বেড়িয়ে পড়েছিলাম কটেজের দিকে। সব বুকিং হয়ে গেছে । এখন কোন ভাবেই ট্রিপ বাতিল করা যাবে না। যা আছে কপালে। কোথাও বের হতে না পারলে ঘরে বসে খিচুরী ডিম ভাজি খেয়ে ,আড্ডা দিয়ে গান কবিতা করে ও শুনে সময় কাটিয়ে দেবো। সেটাওতো মন্দ কিছু না? একঘেয়েমী জীবন থেকে কিছুটা হলেওতো বিরতী। এই অঝর ধারার বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমাদের এক বন্ধুর প্রিয় বার্গার চেম্প বার্গার খাবার জন্য নামলাম সেলবরর্নে। তারপর আবার শুরু হলো পথ চলা। এই পথ চলার যেন কোন ক্লান্তি নেই। বাইরে বৃষ্টি। গাড়ীর ভেতরে সিডিতে বাজছে প্রিয় শিল্পীদের গান। সেলবরর্ন পেড়িয়ে এগুতে থাকলে চোখে পড়লো ডানে বায়ে অসংখ্য উইন্ড মিল্। আগে কখনো একসাথে এত উইন্ড মিল দেখিনি। বেশ অবাক হয়ে ভাবলাম এই ছোট শহরটির নামটি কি উইন্ডমিল শহর দিলে ভালো হতো না? হাইওয়ে টেন ধরে ছুটে চলেছে গাড়ী। একে একে কিছু ছোট ছোট শহর ছেড়ে উচুনীচু পথে সবুজের সমারোহের মাঝ দিয়ে আমরা যাচ্ছি। যখন উপরের দিকে গাড়ী উঠে যাচ্ছে তখন দুরে তাকালে মনে হচ্ছে পথ যেন মিশে গেছে আকাশের সাথে।
ম্যাল্টন, কানাডা