7 C
Toronto
শনিবার, মার্চ ১৫, ২০২৫

কিসমতের কিস্তি

কিসমতের কিস্তি
কিসমতের কিস্তি

তিনজন গাট্টাগোট্টা, শক্তিশালী অফিসার সাথে নিয়ে সিরাজগঞ্জের মেছরা পাড়ায় গেলাম ঋণের কিস্তি তুলতে। লোকটা গত ছয় মাস ধরে বাইম মাছের মতো পিছলিয়ে যাচ্ছে। আজ ধরবো ছাই দিয়ে। গোয়েন্দা লাগিয়েছিলাম; গ্রিন সিগনাল পেয়ে, বাসায় আছে জেনে সন্ধ্যা হবার আগে তার কুঁড়ে ঘরে ঢুকে ধরে ফেললাম। সদস্য কৃষক কে বললাম, বাড়ির সবাই ভালো?
– কার কতা কইতাস্যান? [অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল]
– আপনি?
– ভালা
– আর পরিবার, বাল বাচ্চা?
– অরাও ভালা।
কিছু দূরে উঠোনে ধান গোছাচ্ছে তিন মহিলা। কৌতূহলী বাচ্চাদের দেখিয়ে বললাম, বাচ্চা আপনার?
– কোনডা? ল্যাংডা ডা, নাকি গেঞ্জি গায়ে?
– গেঞ্জি গায়ে?
– অইডা আমার
– আর ন্যাংটা টা?
– অইডাও আমার।
.
চলেন তো আপনার রান্নাঘর দেখি?
ঘরটা তারই, না অন্যের; সেটা পরীক্ষা করতে আমাদের কিছু ট্রিক্স খাটাতে হয়। আমি রান্নাঘরে ঢুকে একটা বড় মাটির ডিব্বায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম, এর মধ্যে কী রাখছেন?
– চাউল
– আর ঐটার মধ্যে? [আরেকটা দেখিয়ে বললাম]
– ওর মধ্যেও চাউল
– ঐ কৌটায়?
– মরিচ গুঁড়া
– আর এইটায়?
– এইডাও মরিচের গুঁড়া, তয় ঝাল একটু বেশি।
খুলে দেখি ঠিকই বলছে। অনেক বাটপার সদস্য আছে। তারা অন্যের বাসা দেখিয়ে, স্থায়ী ঠিকানা বানিয়ে ঋণ নেয়। তারপর দেয় চম্পট। একজন তো ঋণ নিয়ে পরদিন রাতে তার বাড়ির বেড়া, টিন, খুঁটি সব তুলে নিয়ে হাওয়া। পড়েছিলাম মহা বিপদে। প্রোগ্রাম অফিসারের গালিগালাজ হজম করতে হয়েছিল। তাই আমরা বেশ সতর্ক। তাছাড়া কিছু কালেকশন অফিসারেরও কারসাজি আছে। শয়তানের হাড্ডি!
.
ওরা কে?- ঘোমটা দেয়া মহিলাদের দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
– কোনডার কতা কইতাস্যান?
– ঐ সবুজ শাড়ি?
– অইডা আমার বউ
– আর নীল শাড়ি?
– অইডাও আমারই বউ..
– আর কমলা শাড়ি!
– আমার ছোডো বউ..
আমি সতর্ক দৃষ্টিতে সানগ্লাস পরা তিন অফিসারদের সাথে চোখাচোখি করে বললাম, তা ফসল কেমন হইছে?
– কোন ফসলের কতা কচ্চেন?
– ধান?
– ভালা হইসে
– আর পাট?
– পাটও ভালা হইসে
– তা কিস্তি দেন না কেন?
– কোন কিস্তি?
– গরু কেনার?
– চইত মাসে দিমু
– আর পানির পাম্প?
– অইডাও চইত মাসে দিমু
– আপনি বলছিলেন এই শুক্রবারে দিবেন। খোদার কসম কাটছিলেন। ঝামেলা না করে দিয়ে দেন
– আইজ যে টাকা নাই? আরেক শুক্কুরবার আইসেন।
– আমরা ছয় মাসের কিস্তি না নিয়ে যাবো না। সোজা হিসাব!
.
আজ আমাদের আসার পেছনে আরেক কারন হলো আমার শাখার এক অফিসার কিসমতের কিস্তি না পেয়েও আগ্রিমভাবে খাতায় লিখে কিস্তি কালেকশন দেখিয়ে এরিয়া ম্যানেজারের পুরস্কার জিতেছে; কলম আর টুপি। হিসাবের গরমিল আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। সামনেই অর্ধবার্ষিক রিপোর্ট বানাতে হবে। কিস্তি আদায় করতে না পারলে পকেট থেকে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। এরকম আরো কয়েকটা কেইস খুঁজে পেয়েছি। ঋণ আদায়ের হার নেমে গেলে ম্যানেজারের চোখ রাঙানি তো আছেই। সমস্যা হলো অফিসার দুই নাম্বারি করলে সেটার এফেক্ট টপ লেবেলে চলে যায়, চেইন রিএকশন। ইন্সপেকশন করতে আসলে আরও বিপদ। সহজেই ধরে ফেলে। তাছাড়া ইন্সপেক্টর এসে সদস্যের বাড়িও যায়। তখন সদস্যরা মনের ঝাল মিটিয়ে আমাদের দোষ দেয়। এর সাথে আবার পিওন জড়িত। সে-ই সবাইকে বলে দেয় যে ইন্সপেক্টর আসবে। আর ঐ অফিসারকে তলে তলে বদলি করার প্ল্যান করছি; একে কোনোক্রমেই আর রাখা যাবে না। পিওনটা আরও শয়তান।
আমার শাখায় দুজন বাদে সব অফিসারগুলা বদ। একজন আবার পয়সা খেয়ে ঋণ দিয়েছে। গোপনে তদারকি করে নিশ্চিত হয়েছি। এই অফিসার লোকাল পলিটিক্স এর সাথে জড়িত। সরাসরি কিছু বলতেও পারছি না। সন্ত্রাসীদের সাথে উঠাবসা তার। আজ যে করেই হোক কিস্তি তুলতে হবে।
.
উঠানের কর্নারে দুটা গরু বাঁধা। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার গরু?
– কোনডা?
এবার আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো। অফিসারদের বললাম, ব্যাটারে বাঁধেন ভাল করে। ঘরে আটকায়ে ফেলেন।
তারা ধস্তাধস্তি করে কিসমত কে আচ্ছামত বেঁধে তার ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়ে বলল, দুই ঘন্টা পর চাবি নিবেন বাজারের জীবন ফার্মেসি থেকে। তারপর মোটাসোটা একটা গরু নিয়ে আমরা হাঁটা ধরতেই কুঁড়ে ঘরের জানালা দিয়ে কিসমত চেঁচিয়ে উঠলো- সার গো, লাল গরু তো আমার না
– তোর কোনটা? সাদাটা?- আমি জিজ্ঞেশ করি।
– অইডাও আমার না স্যার..
– তাইলে তোর কোনটা?
– কুনোডাই আমার না সার গো.. সব আমার শালার।
.
এক অফিসার বলল- স্যার, কিসমতের শালা খুব ডেয়ারিং! রেখে যান, খুব ঝামেলা করবে!
– তাহলে ছাগল একটা নিয়ে চলেন?
এক অফিসার ফিসফিসিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, স্যার, কোনটা নিবো? খাসি না বকরী?
-খাসিটা নেন
– আর বকরী?
– ঐটাও নেন।
.
রাতে কারেন্ট নাই। আমি অফিসারদের নিয়ে অফিসে বসে কাজ করছিলাম মোমবাতি জ্বালিয়ে। তাড়াহুড়া করে মাসিক রিপোর্ট বানিয়ে পিয়নের হাতে পাঠিয়ে দিলাম এরিয়া অফিসে। এখন সবাই রিলাক্সে চা বিস্কুট খাচ্ছি। প্রতি মাসের শেষেই আমাদের উপর ব্যাপক চাপ যায়। ছাগল দুটো আমার দুই অফিসার কিনে নিয়েছে সস্তায়।

হঠাৎ এক বুড়ি এসে দরজা ধাক্কিয়ে বলতে লাগলো- ও শুনার দল, মানিক আমার, দরজা খোল! তোরা কার ছাগল আনছিস? ওই ছাগল কিসমতের না গো শুনারা। সারা পাড়ার মানুষ জানে আমার ছাগল। ও শুনার দল..
ছাগল আসলেই কিসমতের না হলে বিরাট সমস্যা। এসব এরিয়া অফিস শুনলে বিপদের উপর বিপদ। আমি অফিসারদের ডেকে তাদের হাতে টাকা ফেরত দিয়ে ছাগল দিয়ে দিতে বললাম। রিপোর্টে অলরেডি তার ছয় মাসের কিস্তি এন্ট্রি দিয়ে দেয়া হয়েছে। আর ফেরানোর উপায় নাই।
আমি চিন্তিত মুখে চায়ে চুমুক দিতে থাকি।

- Advertisement -

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles