
তোমরা পুকুরের মাছ নিলে, হাঁস মুরগী চেয়ার টেবিল কত কী নিলে। আমার সেসবে নেই কোন লোভ। আমাকে বরং বত্রিশ নম্বরের এক মুঠো ছাই নিতে দাও। আমি ছাই ছুঁয়ে দেখতে চাই সেখান থেকে একটি শিশুর কান্না বেড়িয়ে আসে কিনা, ‘আমি মায়ের কাছে যাবো’। স্মরণ আছে, সত্যি সত্যি শিশুটিকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মায়ের মৃতদেহের পাশে বসিয়ে তাকেও ধরুম। হ্যাঁ আজ সবগুলো ধরুম ধুরুম আওয়াজ শুনতে চাই যতোটুকু বেঁচে আছে বত্রিশ নম্বরের ছাইয়ের নিচে এবং বাংলার আকাশে। যেমন শুনলাম শিশু যুবক মানুষের চীৎকার জুলাই মাসে। মা মা চিৎকারে যারা আকাশ বাতাস কাঁপিয়েছে। তারাও নিথর হয়েছিল ধরুম ধরুম শব্দ গ্রেনেড এবং রাবার বুলেটে। কিছু লাশ তো ট্রাকের উপরে থাকবে না ট্রাক থেকে পড়ে যাবে সড়কে সেসব নিয়ে ছিল না তাদের কোন অপশন। যতক্ষণ না তারা আদরে আদরে উঠে এসেছিল কোন যুবকের হাতে। হ্যাঁ, তাদেরও থাকেনি তাৎক্ষণিক মৃত্যুর স্বীকৃতি – এই চব্বিশে।
যদি পেয়ে যাই বত্রিশ নম্বরের নিকষ কালো ধ্বংসাবশেষ, কান পেতে অপেক্ষা করবো এক মহীয়সী নারী তাঁর স্বাধীনচেতা স্বামীকে যা বলেছিলেন শ্রবণ করবো তাও – আপনার মন যা বলতে চায় আজ সেটাই বলবেন নির্ভয়ে, রেসকোর্সে লক্ষ জনতা অপেক্ষা করছে। অতঃপর যুগের শ্রেষ্ঠ মন কাড়া সেই কথা, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই’। একবার নয় বারবার শুনবো অতঃপর, অজান্তেই চোখ তুলে নেব আকাশে। যেদিন কান্নার স্বাধীনতা আসবে সেদিন না হয় কাঁদবো।
যদি পেয়ে যাই অমূল্য কিছু অগ্নিদগ্ধ স্মৃতি তবে জিজ্ঞেস করবো কোন পরতে পরতে চাপা পড়ে আছে ‘এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান বাঙালি অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়’। এই অমর বাণীও এসেছিল বত্রিশ নম্বরের আতুর ঘর থেকে। যা দেখতে চেয়েছিলাম সম্প্রতি, সমগ্র বাংলাদেশে।
বলুন, কার কাছে আছে? কোন খালবিল নদীতে ফেলে দিলেন সেই সোনালী ছাই। জাদুঘরের ছাইও জাদুঘর অতএব, যোগাযোগ রাখা দরকার। যা মধ্যাহ্নে মিশে গেল মেঘের হাত ধরে নীরবে। কারোর কাছে ছাইগুলোর ছিলোনা কোন অভিমান। শুধু বলে গেল যেখানেই ফেলবে বত্রিশ নম্বরের ধ্বংসাবশেষ সেখানেই বাংলাদেশ। ছাই হলেও বুঝে গিয়েছিল বর্তমান উল্লাসে সাবলে সাবলে উঠে আসা ছাড়া আর নেই কোন অধিকার, একাত্তর আজ প্রশ্নবিদ্ধ চিত্রকরদের হাতে।
ধরুন যদি পেয়ে যাই বত্রিশ নম্বরের কিছু অবশিষ্ট তবে কপাল গুঁজে দেবো সেখানে। যখন উঠে দাঁড়াবো কপালে মধুমতী নদী চিকচিক করবে। পুনরায় আন্দাজ করে নেব মহান নদীর খরতা। মধুমতীর ছাই ভস্ম নিয়ে এগিয়ে যাবো। জানি না কোনদিকে। হয়তো ডানে, না না ওদিকে না। ওদিকে এখনও আগুন জ্বলছে। হয়তো যাবো বায়ে। ওদিকেও হাতুড়ী শাবলের দম্ভ। বড্ড বিকট শব্দ। যদিও বিমূর্ত ভাস্কর্য পোতা আছে ছাপ্পান্ন হাজার কুটিরে। অন্ধজনেরা অন্তর দেখে না, দেখে শুধু চৌরাস্তার মোড়। সহজেই ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যাব উত্তর কিংবা দক্ষিণে। অথবা কোথাও নয়, মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকবো আনমনে। কী করবো জানি না। তবুও কিছু একটা করতে হবে জানি। এতোগুলো ছাই তাকিয়ে আছে অস্থির হলে কি চলে? আমি দৌড়ব। যদিও পা কাঁপছে। ভয়ে নয় পা দুটো আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। আমার হাত কাঁপছে। হাত দুটোও চোখ রাঙাচ্ছে। আমার শরীর আমাকে থুতু দিচ্ছে। আমি কেমন করে এতো ভীরু হলাম যা কোন কালেই ছিলাম না। কী এমন দেখলাম, কার স্খলনে আমি আজ দ্বিখণ্ডিত। জানি কিছু একটা করতেই হবে। ছাইগুলো জ্বলছে। ভীষণ উত্তাপ ওদের গায়ে। পুরোটাই জীবন্ত। অনেকগুলো প্রাণ।
ডাক্তার!! এখানে কি কোন ডাক্তার আছে? থাকলে আওয়াজ দেবেন। স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে বলবেন ছাইয়েদের হার্ট-বিট সাধারণত কতো থাকে। কী আশ্চর্য কাণ্ড। ডাক্তারের কথা শুনে আরও কতগুলো ছাই উড়ে এলো হাতে। কত হবে? ধরুন চারশো উনত্রিশ। কিংবা আরও বেশি। ওরাও জীবন ফিরে চাচ্ছে। কেউ বলছে সে রাজশাহীর ছেলে। কেউ এসেছে চিটাগাং থেকে। পোশাক বিহীন পুলিশ, শ্রমিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী এবং অবশ্যই সাধারণ ছাত্র। ঢাকা থেকেও এসেছে কেউ কেউ। জানি না অল্পটুকু ছাই এখনও কেন আর্দ্র। হয়তো ওর হাতে পানির বোতল ছিল যা গড়িয়ে পড়েছে নিজ শরীরে। কিছু ছাই তুলতুলে নরম তুলোর মতো। খোলা জানালার বাতাস এখনো লেগে আছে ওর ডিএনএ-তে। ওরা পুড়েছে সদ্য।
আমার এক হাতে বত্রিশ নম্বর অন্য হাতে ভেজা ভেজা ছাই। বাংলাদেশ জ্বলছে। জানি না বাংলাদেশ এতো কেন জ্বলে। এতো অশ্রুপাতের পরও কেন বত্রিশ নম্বর শুষ্ক ছিল। সে কি জ্বলে পুড়ে ছাই হবার জন্য নাকি বত্রিশ নম্বরের ভস্ম থেকে জন্ম নেবে ভবিষ্যতের অন্য কোন শহীদ অথবা অমর কোন কাব্য।
অনেকের মা বাব হয়তো জানে না আজ যারা প্রাণ দিল তারাও একদিন গিয়েছিল বত্রিশ নম্বর। বত্রিশ নম্বর এখন বাঙলার শূন্য উদ্যান। বত্রিশে না গেলে কেউ জানতে পারে না তর্জনী কতোটা উঁচু হলে তাকে সংগ্রাম বলে। বুকের ওপর গুলী না করার শিক্ষাও বত্রিশ নম্বরের সবুজ চত্বর থেকেই উঠে আসা। সর্বজনের জানা এসব কথা, কেউ বলে কেউ বলতে চায় না। অথবা কখনো কখনো কেউ বলে আবার কেউ কখনই বলে না।
স্মরণ করি, আমিও গিয়েছিলাম বত্রিশ নম্বর স্মৃতি জাদুঘরে। দুই হাজার নয় সালে। তারপর লিখেছিলাম, ‘নদীর নাম বত্রিশ নম্বর’। এভাবে;
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একদিন একটি কবিতা লিখবো। তার আগে একবার তাঁকে দেখতে যাব। তাঁর কথা এত শুনেছি। বত্রিশ নম্বর পথটাও চিনি। এই তো, ওয়াই ওয়াই জেড বিমানবন্দর থেকে বসে বসেই যাওয়া যায়। কী এমন দূরত্ব? কোলকাতা থেকে ঢাকার আরমানিটোলা, ফরিদপুর থেকে রংপুর সর্বত্র নাকি গ্রিন গ্রিন গ্রাস শিশির ভেজা অপেক্ষায় থাকে তাঁর জন্য। শুনেছি নদীর পানিও কিছুটা উষ্ণতা ধরে রাখে সারাক্ষণ যদি তিনি ঝাপ দেন আবারো নদীতে খালে কিংবা বিলে। এত কথা শোনার পরেও কেউ কি প্যারিসে গিয়ে আইফেল টাওয়ার দেখতে চাইবে। না মস্কোর ঘণ্টা?
আচ্ছা! আজকাল কি তিনি রেসকোর্সে যান? এরিনমোর টোব্যাকোর ঘ্রাণ ছড়িয়ে সেই পাইপটা টানেন? এখনো কি তাঁকে দেখার জন্য পিতার হাত ধরে শিশুরা এসে দাঁড়িয়ে থাকে ধানমন্ডির লেকের পাড়ে? শুনেছি বাংলাদেশের সব মানুষ গেছে বত্রিশ নম্বর। যারা এখনো যায়নি তারা ছাকনিতে আটকে গেছে। বলতে ভয় হয়, তবু বলি। খুব ইচ্ছে হয় বঙ্গবন্ধুর মত আমারও একটা হাত থাকুক। যেমন খুশি দুলিয়ে দেখবো স্বাধীনতা শব্দটি তর্জনীর আগায় বাজাতে পারি কিনা। খুব সখ হয় বুকটা যেন বঙ্গবন্ধুর মত মজবুত হয়। যাতে বলতে পারি বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না।
এবার আসল কথায় আসি। যদি নিজের ভেতর একটি সিঁড়ি বানাতে পারি তাহলে বলবো এসো পিতা, ভেজা পতাকায় তোমায় ঢেকে রাখি শত আয়ু দিয়ে। একটি নদীর নাম রাখবো তোমার নামে। তোমার কথা শুনতে শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে এবং সে কারণেই বুঝতে পারি যেখানে জলের অভাব সেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম চিকচিক করে না। তাই জল চাই, হোক সে ফোটা ফোটা। গড়িয়ে পড়া। তোমার বত্রিশ নম্বরই বাঙালির মস্কোর ঘণ্টা, প্যারিসের টাওয়ার, নায়াগ্রার জলপ্রপাত। হয়তো দেখে যেতে পারবো তাজমহলের চেয়ে উজ্জ্বল একটি নদী আছে আমাদের। নদীটির নাম বত্রিশ নম্বর।
স্কারবোরো, কানাডা