
এক সময় আমার ঝাঁকড়া চুল ছিলো। সেই হিজলফুলের মতো ঝুলানো ঝাঁকড়া চুলের বাবরি নাচিয়ে ‘বিদ্রোহী’ পড়তাম। মনে হতো এটি নিজের লেখা কবিতা। কারণ, কবির ২২ বছর বয়সে রচিত কবিতার সাথে কোথায় যেন নিজের বেশ মিল খুঁজে পেতাম- হয়তো তারুণ্যের, হয়তো চেতনার, নয়তো বিপ্লবের বা প্রতিবাদের। এই প্রতিবাদটা আমার জানা।
১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। আমি নান্দিনা পাইলট স্কুলের অস্টম শ্রেনির ছাত্র। স্কুল বন্ধ। আমাদের গ্রামের বাড়ি ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে চরাঞ্চলে এবং মুক্তাঞ্চল। মুক্তিযুদ্ধের কারণেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আমার তারুণ্যে, আমার চেতনায় নাড়া দেয় এবং প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে।
কিছু দিন আগে ফেইসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম- ‘নজরুল আমাকে তেমন আকর্ষণ করে না’। তা নিয়ে নজরুলবাদীরা ক্ষুব্ধ হয়ে আমার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে। তখন মনে পড়ছিলো হুমায়ুন আজাদের কথা। তিনি নজরুল গবেষকদের ‘নজরুল মাজারের খাদেম’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
আবার কাজী নজরুল ইসলামের নাম দৈনিক মুক্তকণ্ঠ তাদের প্রিন্টার্স লাইনে ‘কাযি নজরুল ইসলাম রোড’ লেখা শুরু করলে আমিই তীব্র প্রতিবাদ করি। এবং দৈনিক মুক্তকন্ঠের সম্পাদক কে জি মুস্তাফার কাছে প্রতিবাদ করে জানাই, আপনার নাম ‘কে যি মুস্তাপা’ লিখলে কেমন হবে?
আবার আমি টরন্টোতে বাস করে চুরুলিয়ায় নজরুলের দ্বিতীয় কবর নিয়ে নিউজ করি ঢাকার দৈনিকে! লন্ডনে গিয়ে গোলাম মুরশিদ কাজী নজরুল ইসলামের আত্মজীবনীমূলক যে বই লিখেছেন, সেই বই ‘বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত’; তা নিয়ে ভালোমন্দ আলোচনা করি।
নজরুলকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে এনেছেন, নাগরিকত্ব দিয়েছেন। তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয় কিন্তু তাঁকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেয়া হয় নি। তা নিয়ে আমি প্রতিবাদ করি।
নজরুলকে নিয়ে এরকম আমার ব্যক্তিগত অনেক ছোট ছোট মজার মজার ঘটনা আছে। যা আমাকে নজরুল-ভাবনায় জড়িয়ে রাখে। আজ ৪০১ হাইওয়েতে একশ’ কুড়ি মাইলে গতিবেগে যখন গাড়িটা শা শা করে ছুটে যাচ্ছিলো, তখন মনে হচ্ছিলো- এই গতির মধ্যে লুকিয়ে আছে বিদ্রোহী কবিতার তুমুল তীব্রতা।
বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে কলেজ ম্যাগাজিনে একবার ‘প্রবন্ধ’ লিখেছিলাম। তখন ছন্দ নিয়ে মাতামাতি করতাম। জসীম উদদীনের কবিতায় মাত্রাবৃত্ত, বন্দে আলী মিয়ার কবিতায় স্বরবৃত্ত এবং মধুসূদন দত্তের অক্ষর বৃত্তের সনেট পাঠ করতে করতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ছন্দমাত্রা খুঁজতে গিয়ে খেই হারিয়ে ছিলাম এবং লিখেছিলাম- ‘কবিতাটি মাত্রাবৃত্তে রচিত হলেও সর্বত্রই তা রক্ষা হয়নি। অতিপর্ব/ অপূর্ণপর্ব/ তিন মাত্রা/ পাঁচ মাত্রায় জড়ানো’। অনেকটা এ রকম মন্তব্য ছিলো। সেই সাথে আরো কিছু পর্যালোচনা। স্মৃতি থেকে সেই পয়েন্টগুলো পুনঃ আলোচনা করতে চাই।
প্রথম এবং দ্বিতীয় স্তবকেই শব্দের আর অনুপ্রাসের নাচন লক্ষ করা যায়। ‘র’ এবং ‘র’এর নৈকট্য উচ্চারণের সংখ্যা ত্রিশটি।
আর পুরো কবিতায় ‘আমি’র পুনরাবৃত্তি ১৪৭ বার। যা কাব্যভাষার মুদ্রাদোষ এবং সেই সাথে প্রচুর শব্দের চর্বিত চর্বণ! যদিও রবীন্দ্র সুরে এবং জীবনানন্দীয় কাব্যভাষাতেও রয়েছে মুদ্রাদোষ তথা পুনরাবৃত্তি।
তারপরও বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় স্বীকার করতেই হয় এবং হবে- “বাংলা সাহিত্য বিশ শতকে রবীন্দ্র প্রভাব এতো সর্বগ্রাসী হয়েছিল, মনে হচ্ছিল, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না বিদ্রোহী কবিতার নিশান উড়িয়ে হইহই করে নজরুল এসে হাজির হলেন।” প্রকৃত অর্থেই ভিন্ন ভাবনা নিয়ে বাংলা কবিতার জগতকে ঝাঁকিয়ে দিলেন নজরুল।
অথচ ‘পঞ্চ পাণ্ডব’ বলে খ্যাত তাদের আগেই একমাত্র বিদ্রোহী কবিতা দিয়েই রবীদ্র বলয় থেকে বেরিয়ে বাংলা কবিতাকে স্বতন্ত্র মাত্রা দিয়েছেন।
আলোচ্য কবিতাটি বিষয়ে, শব্দের সৌকর্যে, অর্থালংকারে, ধর্মীয় মীথে, উপমায়, উৎপ্রেক্ষায়, রূপকে, ধ্বনি ব্যঞ্জনায় ঝলমলে এবং উজ্জ্বল। যা অদ্বিতীয়!
বিশ্বের সব চেয়ে প্রতিবাদী কবিতা কালো মানুষদের কবিতা। কারণ, তাদের নির্যাতিত জীবন সংগ্রামের সাথে অন্যদের জীবনযাপন সম্পূর্ণ ভিন্ন। কালো মানুষের কবিতায় তার প্রতিফলন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারা যুগ যুগ ধরে অর্থাৎ আদিপিতা থেকে প্রপিতামহ, পিতামহ, পিতা এবং নিজেও নির্যাতিত। ফলে তাদের কবিতার দাবানল জ্বলে। কিন্তু বাংলার বিদ্রোহী কবিতার প্রতিবাদ এবং পরিবেশনা একেবারেই অভিন্ন। এখানে আরো একটি কথা না বললেই নয়; বিদ্রোহী শুধু প্রতিবাদী কবিতাই নয়, মূলতঃ মানবতাবাদী কবিতাও বটে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়- কবিতার মাধ্যমে প্রতিবাদ করে পাবলো নেরুদা, বেঞ্জামিন মোলয়েস, খেত থি, আবদুল্লাহ আতেফি, আমু দরিয়া, ফারহানা-কারিবা, বক্তাশ আবতিন, ওসিপ এমিলিয়েভিচ মান্দেলেশ্তাম, ইবনে আল-আশরাফ, আবু আফাক, ওক্ববা বিন আবু মোয়াইত, নদর বিন আল-হারিস, আসমা বিনতে মারওয়ান প্রমুখ কবিরা শাসকগোষ্ঠি কর্তৃক নানা ভাবে প্রাণ দিয়েছেন।
আবার অনেকেই জেল-জুলুমে নির্যাতিত হয়েছেন। কবিতা লেখার অপরাধে নজরুলও জেল খাটেন। তবে ‘বিদ্রোহী কবিতার জন্য নয়। সেই কবিতাটি হচ্ছে- ‘আনন্দময়ীর আগমন’। এই কবিতাটির জন্য কবিকে ১৯২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতীয় দন্ডবিধির ১২৪-এ এবং ১৫৩ ধারানুসারে বিচারপতি সুইনহো বিদ্রোহী কবিকে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেন।
সামুদ্রিক ঝড়ের মহা বিপদ সংকেত শব্দকে, ভাষাকে, ভাবনাকে তছনছ করে টর্ণেডোর বেগে নজরুল সৃষ্টি করেছেন প্রায় দেড়শ’ পঙক্তির আগ্নেয় বিস্ফোরণ। তুমুল আবেগ আর কি তীব্র বেগে পুরো কবিতা এক অসাধারণ ধারাবাহিক কাব্য বিন্যাস।সামুদ্রিক ঝড়ের মহাবিপদ সংকেত শব্দকে, ভাষাকে, ভাবনাকে তছনছ করে টর্নেডোর বেগে নজরুল সৃষ্টি করেছেন ১৪১ চরণ বা পঙক্তির আগ্নেয় বিস্ফোরণ। তুমুল আবেগ আর কি তীব্র বেগে পুরো কবিতা এক অসাধারণ ধারাবাহিক কাব্য বিন্যাস।
কবিতায় ব্যবহৃত কিছু শব্দ উদাহরণ দিচ্ছি; চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, প্রলয়, সাইক্লোন, ধ্বংস, দুর্বার, চুরমার, উচ্ছৃঙ্খল, টর্পেডো, মাইন, ঝঞ্ঝা, ঘূর্ণি, চূর্ণি, ধূর্জটি, এলোকেশে ঝড়, কাল বৈশাখী, হিম্মত-হ্রেষা, রৌদ্র-রুদ্র, স্বেচ্ছাচারী, উন্মাদ, আগ্নিয়াদ্রি, ভূমিকম্প, সর্বনাশী, জাহান্নামের আগুন প্রভৃতি শব্দ কবিতাকে উলট-পালট করে দিয়েছে, বাড়িয়ে দিয়েছে কবিতার তু্মুল তীব্রতা এবং অসীম উচ্চতা।
কবিতাটি কিভাবে শেষ হয়েছে? লক্ষ্য করুন, কবি ভগবান বুকে পদ-চিহ্ন এঁকে দিয়ে বলছেন- ‘বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির’!
ইস্টইয়র্ক, কানাডা