
হসপিটাল থেকে বাসায় ডুকেই মাধবীলতা দেখলো বাবা ড্রয়িং রুমে বসে আছে। মাধবীলতাকে দেখেই বললো-
– কিরে মা। এত সকালে কোথায় গিয়েছিলি? কাজের লোকদের কিছু বলে যাসনি। রুনুর মা বললো- কি জরুরি দরকার পরেছে তাই নাকি বের হয়েছিস। কি হয়েছে মা?
– বাবা তুমি সকালে নাস্তা করে ঔষধ খেয়েছিলে?
– সে খেয়েছি। তোর কথার বাহিরের যাব, এমন সাহস আমার হবে। এখন বল কি হয়েছে? ফোন দিলাম ফোনও ধরলি না!
– বাবা, আমি একদম ঠিক আছি। একটু হসপিটালে গিয়েছিলাম।
– হসপিটালে!! ( অবাক হয়ে) কেন? তোর কি হয়েছে?
– ওহ বাবা, আমার কিছু হয়নি। সব বলছি।
এরপর সে সবটা খুলে বললো। শুধু লুকিয়ে গেলো লোকটার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকা ও ঠিকানা খোঁজা এবং তার রোগ এই তথ্যগুলো। সব শুনে বাবা বললেন-
– ভালো করেছিস মা। খুব ভালো করেছিস। যা এখন ফ্রেস হয়ে খেয়ে নে।
– আচ্ছা।
– শুন
– বলো
– আজ ভার্সিটিতে যাবি না?
– না বাবা। টায়ার্ড লাগছে।
– ঠিক আছে।
বাবার সাথে কথা শেষ করে স্নান সেরে নাস্তা করতে বসলো সে। রুনুর মা বললো-
– আফা, লোকটা এখন কেমন আছে?
– ভালো, জ্ঞান ফিরেছে।
– তারে কিছু জিগান নাই?
– কি জিজ্ঞেস করব?
– লোকটা কাল ওইভাবে খাড়াইয়া আছিলো ক্যান আর ভিজলো ক্যান। আমার মন কইতাছে আফা, কিছু ঝামেলা আছে।
– বড্ড বেশি কথা বলো তুমি। লোকটা অসুস্থ, তার তাকে আমি এগুলো জিজ্ঞেস করব! তুমি না আসলেই!
রুনুর মা কিছু বললো না। একটু পরে মাধবীলতা আবার বললো-
– থাক হয়েছে। আর গাল ফোলাতে হবে না। কিছু জানলে জানাব তোমায়।
আর শুনো, আমি একটু শুয়ে থাকব। ভালো লাগছে না। বাবা খুজলে বলো, আমি ঘুমাচ্ছি।
মাথা নাড়লো রুনুর মা। ঘুমানোর কথা বললেও ঘুম আসছে না তার।
লোকটার কথা কেবলই মনে হচ্ছে তার। লোকটার এত বড় রোগ, বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকা, বাড়ির ঠিকানা, বৃষ্টিতে ভেজা, তার কথা না বলা, তাকিয়ে থাকা। সব কেমন যেন লাগছে তার। কেবলই মনে হচ্ছে লোকটা তাকে চিনে এবং কিছু বলতে চায়।
বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করলো মাধবীলতা। কিন্তু ঘুম এলো না। উঠে বাবার রুমে গেলো। বাবার কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে বললো-
– বাবা, আমি তোমার কাছে একটু বসি।
– কি হয়েছে মাধু? এমন করে বলছিস কেন?
মাধবীলতা না বসে বাবার পিছন থেকে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো –
– বাবা, মায়ের কথা মনে পড়ছে আজ?
বাবা সে কথা উত্তর না দিয়ে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-
– তোর কি হয়েছে মাধু? বল আমাকে?
– জানো বাবা। লোকটাকে যখন হসপিটালের কেবিনে শুয়ে থাকতে দেখলাম। তখন মায়ের কথা মনে পড়লো। মাকেও এমন করে হসপিটালে দেখেছিলাম।
এরপর কেউ কোন কথা বললো না। কিছুক্ষন চুপ থাকার পর। মাধবীলতা বললো-
– জানো বাবা। ডাক্তার বললো,লোকটা নাকি বেশিদিন বাঁচবে না।
– কি বলিস। কি হয়েছে তার?
– ক্যান্সার। জানো বাবা আমি লোকটাকে যখন কেবিনে দেখতে গেলাম, সে আমার দিকে অদ্ভূদ ভাবে তাকিয়ে ছিলো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন? কোন উত্তর দিলো না।
– কেন?
– জানি না।
এমন সময় রুনুর মা রুমে ডুকে বললো
– স্যার, আপনার স্নানের জল রেডি।
– তুই যা। আসছি আমি।
পরের দিন ভোরে বাসা থেকে বের হলো মাধবীলতা। হসপিটাল হয়ে তারপর ভার্সিটিতে যাবে সে। হসপিটালে গিয়ে দেখলো লোকটা ও তার ড্রাইভার বসে বসে কথা বলছে। তাকে দেখেই ড্রাইভার মতিন মিয়া চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মাধবীলতা বললো
– কি অবস্থা মতিন মিয়া?
– জ্বি ম্যাডাম, ভালো।
– আমি চলে যাওয়ার পর কোন কোন সমস্যা হয়েছিলো?
– না,ম্যাডাম। ভাইজানের একটু জ্বর ছিলো। তবে এখন ফুরফুরা। ২ জনে গল্প করতেছিলাম।
মাধবীলতা বুঝলো, মতিন মিয়া আর লোকটির মধ্যে ভালোই খাতির হয়েছে এর ভিতর। এমন সময় নার্স ঔষধ খাওয়াতে রুমে ডুকে বললেন
– রুগীর ঔষধ খাওয়ানোর টাইম হয়েছে। একটু সরে দাঁড়ান প্লিজ।
ঔষধ খাওয়ানো শেষে মাধবীলতা নার্সকে জিজ্ঞেস করলো-
– পেসেন্ট এখন কেমন আছে?
– আগের থেকে ভালো। বোধহয় কালকের মধ্যেই জ্বর ঠিক হয়ে যাবে। আপনি একবার ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন। ১০ মিনিট পরে উনি চেক আপ করতে আসবেন।
– আচ্ছা।
নার্স চলে গেলে কেবিনটা চুপ হয়ে গেলো। নিরবতা ভেঙে মাধবীলতা বললো-
– মতিন মিয়া, তুমি বাসায় চলে যাও। আমি ঘন্টা ২ এক আছি। তারপর ভার্সিটিতে যাব। লাগলে তোমাকে জানাব।
– না, ম্যাডাম। আমার থাকলেও সমস্যা নেই। রুদ্র ভাই খুব ভালো মানুষ। আমি এখানে হোটেলে খেয়ে নেব।
মাধবীলতা মনে মনে বললো- আচ্ছা, লোকটার নাম তাহলে রুদ্র। পরক্ষণেই বললো-
– না। তুমি বাসায় গিয়ে রেস্ট করো।
মতিন মিয়া চলে গেলো। মাধবীলতা খেয়াল করলো, মতিনের দিকে তাকিয়ে একটু হালকা হাসলো লোকটি। হাসিতে বেশ মাধুর্য আছে। এমন সময় পিছন থেকে ডক্টর বললো
– হ্যালো ইয়াং ম্যান। হাউ আর ইউ?
– (সামান্য হেসে) নাও ফাইন।
এবার মাধবীলতাকে উদ্দেশ্য করে ডাক্তার বললেন-
– ম্যাডাম। সে এখন অনেকটা ভালো। আগামীকাল আপনি চাইলে তাঁকে বাসায় নিতে পারেন। তবে প্রতিনিয়ত চেকআপ আর নিয়মের ভিতর রাখতে হবে।
একটু থেমে মাধবীলতা বললো- তার কাছে কি আজ অলটাইম বাড়ির কাউকে থাকতে হবে?
– সেটা আপনাদের ইচ্ছে। এমনিতে কোন সমস্যা নেই।
– ওকে। থ্যাংকস।
– ওয়েলকাম। বাট বি সিরিয়াস এব্যাউট হিমসেল্ফ।
মাথা নাড়লেন মাধবীলতা। ডাক্তার চলে গেলেন। কেউ কোন কথা বলছে না। কেমন যেন দম বন্ধ লাগছে মাধবীলতার। সে লোকটির দিকে তাকাতেই দেখলো – লোকটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। জড়তা ভেঙে মাধবীলতা বললো-
– আপনার নাম রুদ্র?
– রুদ্রনীল চ্যাটার্জি।
– ওহ। বাসা কোথায় আপনার?
– পিরোজপুর।
– এখানে কার কাছে এসেছেন?
– আপনার কাছে।
– আমার কাছে? কেন?
কোন উত্তর পেলো না মাধবীলতা। একটুপর বললো-
– আপনি আপনার পরিবারের ফোন নাম্বার দিন। তাদেরকে বলি আপনার কথা। আপনি তো একা ফিরতে পারবেন না। কেউ এসে আপনাকে নিয়ে যাগ।
-( আস্তে আস্তে) আমার তেমন কেউ নেই।
বলেই মাধুবীলতার মুখের দিকে তাকালো সে। মাধবীলতা দেখলো, তার চোখের কোনে জল চিকচিক করছে। বেশ বিব্রত বোধ করলো মাধবীলতা। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল সে। বললো-
– আমার ভার্সিটির সময় হয়ে গেছে। আপনি থাকুন। বিকেলে ফেরার সময় দেখা করব। বলেই চলে যাচ্ছিলো সে। পিছন থেকে লোকটি বললো-
– বিকেলে ঠিক আসবে তো মাধুকরী!!