
বাংলাদেশ থেকে আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধু টরন্টোতে বেড়াতে এসেছিলেন গত সামারে। স্কারবোরোর অন্টারিও লেকের পাশে ওর এক আত্নীয়ের বাসায় উঠেছিল।
টরন্টোতে আসার আগেই ও আমাকে বলে রেখেছিল, ওকে যেন কোন একদিন সারাদিন সময় দিই।
কথা মোতাবেক, একদিন সারাদিন ওকে সময় দিলাম।
দেখা হলে জিজ্ঞাসা করলাম, বল, টরন্টোতে কোথায় কোথায় ঘুরতে চাস?
ও বলল, ঘুরতে চাইনা বন্ধু। তুই শুধু একজন লয়ায়ের সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দে।
বললাম, কী বিষয়ে কথা বলবি?
ও বলল,বউ বাচ্চাকে কানাডায় পার করতে চাই সে বিষয়ে।
বললাম, আমাদের কমিউনটির কোন লয়ার নাকী বাইরের কেউ?
ও বলল, দেখ বাইরের কেউ হলে ভালো হয়।
সে মোতাবেক তখনই গুগলে সার্চ করে একজনের সাথে ঐ দিনই এপোয়েন্ট করতে চাইলাম।
অন্তত দশটা ফোন করলাম। কোন লইয়ার সেদিন এপোয়েন্টমেন্ট দিতে রাজী হল না।
কেউ পরদিন, কেউ এক সপ্তাহ পরে এ্যাপয়েন্টম্যান্ট দিতে রাজী হয়।
তার ওপর একঘন্টার জন্য কেউ চাইল ৫০০ ডলার, কেউ ৪০০ ডলার। কেউ আবার ৬০০।
বন্ধু হতাশ হলেন। হয়ত দুটো কারনে। এক, ঐদিনই এপোয়েন্ট নেই। দু্ই, ৫০০/৬০০ ডলার ফি। তাও আবার এক ঘন্টার জন্য।
বললাম, আমাদের কমিউনিটির কাউকে পাওয়া যেতে পারে আজকেই। আর ফিও কম লাগবে। চেষ্টা করবো?
বন্ধু বলল, ঠিক আছে ব্যবস্থা কর।
একজন ব্যারিস্টারকে ফোন দিলাম। উনি ফোন ধরলেন। ব্যারিস্টারগণ খুব ব্যস্ত থাকেন। তাদেরকে অফিস টাইমে ফোনে পাওয়া যায়না। যাক ফোনে ওনাকে বিস্তারিত বললাম।
ব্যারিস্টার সাহেব বলল, মোস্তফা ভাই, এখনই চলে আসেন। আমি অফিসে আছি।
কাছেই ছিলাম। দশ মিনিটের মধ্যে ওনার অফিসে পৌঁছে গেলাম। রিসিপশনে গিয়ে উদ্দেশ্য বললাম। রিসিপশনিস্ট ওনাকে ফোন করে জানালেন। সাথে উনি বের হয়ে এসে ভিতরে নিয়ে গেলেন।
কথা হল প্রায় আধা ঘন্টা। আমার বন্ধুর অনেক ইমিগ্রেশন বিষয়ক প্রশ্ন ছিল। তার সব উত্তরই ব্যারিস্টার সাহেব দিলেন।
বন্ধু বেশ খুশি।
আলাপ শেষে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার ফি কত?
উনি বললেন, আরে কী যে বলেন, আপনার কাছ থেকে ফি নিবো?
তারপরেরও ওনাকে অনেক জোড়াজুড়ি করলাম। কিছুতেই ফি নিলেন না।
বের হয়ে আসলাম।।আমার বন্ধু বাঙালী এই ব্যারিস্টারের সেবায় বেজায় খুশি হলেন।
এই ব্যারিস্টার সাহেব আর কেউ নন, রিজুয়ান রহমান যিনি আজকে দুপুরে দেহত্যাগ করেছেন। ইন্না লিল্লাহ…রাজী উন।
রিজুয়ানের সাথে আমার পরিচয় বেশ কয়েক বছর আগে যখন উনি কানাডার টরোন্টোতে নিউকামার।
বিআইইএসের একটি অনুষ্ঠানের মাধমে প্রথম পরিচয়। এটি একটি বেসরকারী সংস্থা।
এ সংস্থার কোন একটি চাকুরী খোঁজার ওয়ার্কশপে তার সাথে প্রথম পরিচয়।
ওয়ার্কশপ শেষে পিছনে বসা একজন ইয়াং স্মার্ট যুবক উঠে দাড়িয়ে চমৎকার করে কথা বললেন। ইমপ্রেসিভ সব কথাবার্তা। সে দিন থেকে শুরু।
এর পরে অনেকবার কথা হয়েছে। দেখা হয়েছে। এক সাথে খেয়েছি। আড্ডা দিয়েছি। গান শুনেছি। গান গেয়েছি। তার স্বপ্নের কথা শুনেছি।
উনি বিআইইএসের বোর্ড মেম্বার হিসেবে দায়িত্বও পালন করেছেন।
অবশ্য গত পাচ বছর যাবত আমার সাথে রিজুয়ানের সরাসরি যোগাযোগ কমে যায়। তবে তার সাথে আমার কানেকটিভিটি ছিলই। একসেসও ছিল।
রিজুয়ান ছিল একজন স্বপ্নবাজ মানুষ। তার রাজনৈতিক স্বপ্ন ছিল বেশ উঁচু। তিনি বলতেন, মোস্তফা ভাই, আমার পরিষ্কারর আলাপ, প্রথমে এমপি হবো। তারপর মন্ত্রী।
সে অনুযায়ী তিনি অগ্রসরও হচ্ছিল।
এক সময় তিনি ব্যারিস্টার হলেন। অল্প দিনেই তাঁর আইনী ব্যবসার প্রসার হল।
এক সময় ডলি বেগমকে বিয়ে করলেন। ডলি বেগম দুদুবার এমপিপি হল।
কমিউনিটির জন্য টরেন্টোর ডেন্টোনিয়া পার্কে শহীদ মিনার স্থাপনের নেতৃত্বও দিলেন।
এভাবে নানান সামাজিক কাজের সাথে নিজেকে জড়িয়ে টরোন্টোতে বেশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন রিজুয়ান।
ভদ্রলোক ছিলেন। অমায়ায়িক ব্যাহারের জন্য সবার প্রিয়পাত্রও হয়েছিলেন।
গত দুতিনবছর ধরে ক্যান্সারের সাথে লড়ছিলেন। সে কথা তার বয়ানে শুনেছি।
সারভাইভও করেছিলেন।
কিন্তুু তারপর কী হল? বোঝা গেলনা। ক্যান্সার আবার ফিরল। রিজুয়ান এবার সফল হলেন না।
উনি অবশ্য বুঝতে পারছিলেন ওনার সময় শেষ। সেজন্য প্রস্তুতিও ছিল।
একজন মানুষ যখন জানে যে, তার আর বেশি সময় নেই তখন তিনি মানসিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে যান। রেজুয়ানকেও সে রকম মনে হচ্ছিল।
আমরা সবাই একদিন চলে যাবো। তবে রিজুয়ান একটু আরলি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
তবে উনি বর্নাঢ্য জীবনযাপন করে গেলেন।
উনি জীবনে অনেক কিছু পেয়েছেন। বেঁচে থাকলে টরন্টোতে বাঙালী কমিউনিটির জন্য আরো হয়ত অনেক কিছু করতে পারতেন। কারন তাঁর ভিতরে নেতৃত্বের গুণ ছিল।
সমাজ পরিবর্তনে ও মানুষের জন্য কিছু করতে নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন মানুষ দরকার হয়। রিজুয়ান সে রকম একজন মানুষ ছিল। কিছু দোষ হয়ত তারও ছিল। কিন্তুু সেগুলো উৎড়িয়ে ভালোগুণই বেশি ঔজ্জ্বল ছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, সুখি হওয়া সহজ, কিন্তুু সহজ হওয়া কঠিন।
আমার কাছে রিজুয়ানকে সুখি ও সহজ–দুটোই মনে হত।
আমি রিজুয়ানকে এভাবেই দেখেছি। তার আত্না শান্তিতে থাকুক।
স্কারবোরো, কানাডা