-5 C
Toronto
বুধবার, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫

চিত্রার প্রয়াণ

চিত্রার প্রয়াণ
চিত্রার প্রয়াণ

নিতুর ছিমছাম সুন্দর কায়াতে স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে হালকা গোলাপি রঙের একটি শাড়ি জড়ানো। মুখে ভারি সাজ, খোলা চুল। সিল্কের শাড়ি, শরীরের ওপরের অংশে শাড়ি থাকলেও অনেকাংশই দৃশ্যমান উদর এবং বুকের। লম্বাটে ধরনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিতু রিলস বানাচ্ছে। তার ডান পাশে রিং লাইট, সেখানে ফোন কায়দা করে রাখা। গান চালু করে সবে ভিডিও শুরু করতে যাচ্ছিল ঠিক তখন বসার ঘর হতে মাধবী হাঁক ছেড়ে ডাকা শুরু করলেন। নিতু মায়ের ডাক শুনে চোখে মুখে বিরক্তি নিয়েই বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালো সেই অবস্থায়ই। বসার ঘরে মাধবীর সাথে সোফায় বসে কথা বলছিল শোভন। নিতুকে দেখে এক পলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। নিতুর মনঃক্ষুণ্ন হলো বটে, সে চাচ্ছিল শোভন মুগ্ধ চোখে তাকুয়ে থাকুক তার দিকে। এমন মোহময়ী রূপে কোনো তনয়া সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে হা করে তাকিয়ে থাকাটা স্বাভাবিক বরং না তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়াটাই অস্বাভাবিক। নিতু এগিয়ে গেল, শোভনের পাশের সোফায় যেয়ে বসলো। নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
“ কেমন আছেন শোভন ভাই? ”
শোভন না তাকিয়েই জবাব দিল,
“ ভালো আছি। ”
পরপর মাধবীর উদ্দেশ্যে বললো,
“ আঙ্কেলের শরীরটা কেমন আন্টি? ”
“ বয়স হয়েছে আর কত ভালো থাকবে! তা-ও ভালোই আছে। ”
শোভন অবাক হলো না, মাধবী বরাবরই এভাবে কথা বলেন। কথার ধরনে মনে হয় স্বামী সুস্থ আছেন ব্যাপারটা ওনার ভালো লাগছে না। শোভন কথা না বাড়িয়ে কাজের কথায় আসলো। বললো,
“ গতকাল আম্মু বললো চিত্রা নাকি অসুস্থ। এখন কেমন আছে? ”
চিত্রার প্রসঙ্গ আসায় মাধবীর মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। শোভন বা তার পরিবারের চিত্রার প্রতি অতিরিক্ত চিন্তা দেখানোর ব্যাপারটা ওনার বিশেষ পছন্দ না। প্রসঙ্গ বদলাতে চাইলেন উনি কিন্তু লাভ তেমন হলো না। এবার কণ্ঠে অতিরিক্ত মিষ্টতা এনে বললেন,
“ বাবা চিত্রা তো ছাঁদে আছে, এখন নিচে নামবে না মনে হয়। তুমি বসো হাত মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হও। বিরিয়ানি রান্না করেছি খেয়ে যাও। ”
মাধবী চোখ দিয়ে ইশারা করলেন নিতুকে। নিতুও বলা শুরু করলো,
“ হ্যাঁ হ্যাঁ আম্মু ঠিক বলছে। আপনি ফ্রেশ হয়ে খেতে বসুন। ততক্ষণে চিত্রাও নিচে নেমে আসবে। ”
“ আমি অফিস থেকে সোজা এখানে এসেছি আন্টি। চিত্রার সাথে দেখা করতে। ”
মাধবী বাধ্য হয়ে নিতুকে বললেন,
“ নিতু মা দেখোতো, চিত্রাকে ডেকে আসো। ”


“ চিত্রা আপা শোভন ভাই এসেছে, তোমাকে ডাকছে৷ ”
অন্যমনষ্কা রমণী ছাঁদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছোট বোন নিতুর কথা শুনেও তার মাঝে তেমন ভাবান্তর নেই। নিতুর দিকে একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল বিস্তীর্ণ নীলাভ অন্তরিক্ষে। স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“ আমি নিচে নামতে পারব না এখন। ”
নিতু সহসা মুখ ঝামটা দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“ ভাব কত! সে নিচে নামতে পারবে না। কোথা থেকে কোথায় এসে পড়েছে আর সে শোভন ভাইয়ের মতো মানুষের ডাকে নিচে নামবে না। ”
বিড়বিড় করে বলা নিতুর কথাটা চিত্রা পুরোপুরি শুনতে পেল। দুঃখ পাওয়ার বদলে অধর জুড়ে অদ্ভুত হাসি দৃশ্যমান। মৃদুস্বরে জানান দিল,
“ আমার জবাব যে এটাই হবে সেটা তুই জানিস। তাহলে ডাকতে আসিস কেন? ”
নিতু আরও ক’টা কথা শুনিয়ে নিচে নেমে গেল। চিত্রা সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। এই মেয়েটার মুখ দেখে কেউ বলতে পারে না তার ভেতরকার অবস্থা কেমন! মানুষ হাজারটা কটু কথা বললেও বিনিময়ে পাল্টা জবাব সে কখনো দেয় না। কীভাবে দেবে! সে পাল্টা জবাব দেয়ার পর পরবর্তীতে যা হবে তা সামলানোর জন্য যে সাহসটুকু দরকার তা দেয়ার মতো তার কেউ নেই। এমন না যে তার পরিবার নেই। বাবা-মা, বোন সব ই আছে। বাইরের মানুষ দেখলে পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে বলবে আগাগোড়া সুখী একটি পরিবার, কানায় কানায় সুখ দিয়ে পরিপূর্ণ। অথচ ভেতরের খবর কী কেউ রাখে? রাখে না তো। যদি রাখতো তাহলে অবশ্যই জানতে পারতো এই পরিবারের সবচেয়ে অবহেলিত আর দুঃখী মেয়েটি হচ্ছে এই চিত্রা। শারীরিক মানসিক দুই দিক দিয়েই অসুস্থ, অসুখী সে।
“ চিত্রা! ”
ডাক শুনে চিত্রার ঠোঁটের কোণ থেকে অদ্ভুত রকমের হাসিটা উবে গেল৷ এবার অধর আরও প্রসারিত হলো। সে জানতো প্রতিবারের ন্যায় আজকে ও সে নিচে নামতে পারবে না জেনে শোভন নিজেই ছাঁদে উঠে আসবে। চিত্রা নীল রঙা শাড়ির আঁচলটা নিচের দিক দিয়ে আরেকটু ছড়িয়ে দেয়। কোমড় সমান কৃষ্ণ কেশগুচ্ছ তার ছড়িয়ে আছে পিঠের ওপর। বেশ শখের ছিল তারা, এখন অযত্নে বেড়ে উঠছে, ঝরছে আবার নতুন করে গজাচ্ছে। চিত্রা হাসি মুখে শোভনের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। শোভনের মুখের রঙ বদল হয় না, চোখ জোড়া খানিক নিভে আসে যেন। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“ চিত্রা কেমন আছো? ”
চিত্রা কেমন আছে তা জিজ্ঞেস করার মতো মানুষ তার জীবনে খুবই কম। সে কম মানুষের মধ্যে শোভন একজন যে দেখা হলেই তাকে জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছো চিত্রা? চিত্রা মুগ্ধ হয়, তার নামটা শোভনের মুখ থেকে শুনতে এত ভালো লাগে তার! মনে হয় তার নামের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়ে যায়। চিত্রা ভালো থাকুক কিংবা খারাপ সবসময় একই রকম উত্তর দেয়। আজকেও দিল,
“ আমি ভালো আছি শোভন ভাই। আপনি কেমন আছেন? ”
“ এই তো ভালো। ”
চিত্রা মাঝেমধ্যে ভীষণ গম্ভীর হয়ে চিন্তা করে এই মানুষটা মনস্তাত্ত্বিক হলো না কেন! মনস্তাত্ত্বিক হলে চিত্রার চোখ মুখ দেখেই তার মিথ্যা ধরে ফেলতে পারতো। বলতে পারতো,
“ তুমি মিথ্যে বলছো চিত্রা, তুমি ভালো নেই। তুমি অসুস্থ, ভীষণরকমের অসুস্থ। ”
কিন্তু এমন কিছু ই কখনো হয়নি, সে মুখে যা বলে অন্যদের মতো শোভনও তা-ই বিশ্বাস করে। নিজের চিন্তা ভাবনা আর বেশি গভীরে যাওয়ার আগেই চিত্রা তার ইতি ঘটালো। শোভনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“ শোভন ভাই, অফিসে যাননি কেন আজকে? ”
“ গিয়েছিলাম। কাজ গুছিয়ে দিয়ে চলে আসছি। শুনলাম তুমি অসুস্থ তাই দেখতে আসলাম। ”
“ আমার অসুখ তো পুরোনো। দুইদিন পরপরই অসুখ হয়। ”
“ তোমাকে কত করে বললাম চিত্রা ডাক্তার দেখাও। ডাক্তার দেখানোতে কী সমস্যা তোমার! ”
“ দেখাব! ”
“ কবে? দুই মাস ধরে এই কথাই শুনছি। ”
“ সময় বুঝে দেখাব৷ আপনার কথা বলুন। কেমন আছেন? ”
“ ভালো আছি। ”
“ শুনলাম আন্টি না-কি আপনাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছে! ”
চিত্রা কিছুটা ভয় নিয়েই প্রশ্নটা করলো। শোভন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো,
“ হ্যাঁ। অভিক ভাইকে বলেছিল কিন্তু ভাই রাজি হচ্ছে না। বলছে আপাতত নিজের কাজ নিয়েই সব পরিকল্পনা। অন্যদিকে মনোনিবেশ করতে চায় না। আম্মুও নাছোরবান্দা ছেলে বিয়ে করিয়ে ছাড়বেন। ”
“ আপনি আন্টির কথা ভেবে বিয়ে করতে চাইছন? ”
“ আমিও এখন বিয়ে করতে চাই না চিত্রা। বিয়ে-শাদি ঝামেলার ব্যাপার। দায়িত্বও আছে। ”
চিত্রার মনঃক্ষুণ্ন হয় এহেন জবাব শুনে। মৃদু স্বরে বলে,
“ শোভন ভাই…বিয়ে ব্যাপারটা মোটেও ঝামেলার না৷ ঝামেলা হিসেবে না দেখে স্বাভাবিক জীবনের আরেকটা অধ্যায়ের মতো দেখুন। তাহলে ঝামেলা মনে হবে না। আর গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে কাকে বিয় করবেন? ”
“ মা দেখছেন। যাকে পছন্দ হয়। ”
“ আন্টি অবশ্যই আপনার জন্য ভালো পাত্রীই খুজঁবেন। কিন্তু আমার মনে হয় নিজের পছন্দকেও গুরুত্ব দেয়া উচিত। আপনাকে একটা উপদেশ দিই? ”
“ উপদেশ দিবে! তুমি? মনে আছে ছোটবেলায় তোমাকে ভীতুর ডিম বলে ক্ষ্যাপাতাম! ”
চিত্রা মুখ ভার করে জবাব দিল,
“ মনে আছে। অভিক ভাই দিয়েছিল এই নাম। ”
“ হ্যাঁ কারণ তুমি ছিলে এক নাম্বারের ভীতু। তোমার কাজই ছিল শুধু কান্না করা। মনে আছে ক্লাস নাইনে থাকতে অসুস্থ থাকায় কয়দিন স্কুলে যেতে পারোনি। সাতশো টাকা জরিমানা হয়েছিল। বাসায় জরিমানার কথা কীভাবে বলবে সেটা ভেবে কেঁদেকেটে বুক ভাসাচ্ছিলে। ”
চিত্রার মনে পড়লো, আনমনেই হেসে ফেললো মেয়েটা। শোভনের মতোই উৎসাহ নিয়ে বললো,
“ হ্যাঁ পরে আপনি আর অভিক ভাই নিজেদের জমানো টাকা মিলিয়ে জরিমানা দিয়েছিলেন। ”
“ হ্যাঁ আর সেই তুমি বলছো উপদেশ দিবে। ”
“ হ্যাঁ তো! তখন ছোট ছিলাম এখন তো বড় হয়েছি। ”
“ শুনি তাহলে কী উপদেশ দিবে। দেখি কতটুকু বড় হয়েছো। ”
চিত্রার মুখে হাসি ফুটলো, বিজ্ঞদের মতো হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললো,
“ দেখুন, আন্টি যে মেয়েকে পছন্দ করবে তার সাথে আগে একা দেখা করবেন। তাকে কৌশলে জানার চেষ্টা করবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মেয়েটা মানুষ হিসেবে কেমন সেটা জানা। প্রয়োজনে কয়েকবার দেখা করবেন। ”
“ বুঝব কীভাবে যে আমার জন্য উপযোগী মেয়ে কোনটা? ”
চিত্রা এহেন প্রশ্নে থমকায়, চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে বলে,
“ যাকে দেখলে আপনার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাবে। যার সাথে থাকলে আপনার নিজেকে সুখী মনে হবে। যে আপনাকে বুঝবে। আর হ্যাঁ দেখতে সুন্দর হলেই গলে যাবেন না। খতিয়ে দেখবেন মনের দিক দিয়ে সে কেমন। ”
শোভন বাধ্য পাত্রের ন্যায় মাথা ঝাঁকালো, বললো,
“ বাব্বাহ আমাদের ভীতুর ডিম চিত্রা এত বড় হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। বিয়ের তোড়জোড় শুরু করতে হবে দেখছি। ”
শোভন শব্দ করে হাসলো, তার সাথে চিত্রাও হাসলো। শোভন দেখলো হাসতে হাসতেও মেয়েটার চোখ চিকচিক করছে। চিত্রা কি কাঁদছে? এবারও জিজ্ঞেস করা হলো না ওকে। ভাবলো কাঁদবে কেন! হাসতে হাসতে মানুষ কাঁদতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর শোভনের দৃঢ় চিত্তে উদ্রেক হলো না। বুঝে এলো না এত কি দুঃখ এই শুভ্রাঙ্গণার?

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles