
প্রত্যেকটা বয়সেই শরীর ও মনের একটা নিজস্ব প্রয়োজন এবং চাহিদা থাকে। সেই অনুযায়ী সাজিয়ে ফেলতে হয় জীবনধারণ, ফিটনেস প্ল্যান। তা হলেই বয়স ধরে রাখা কোনো সমস্যাই নয়। যেকোনো বয়সেই সুস্থ এবং ফিট থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে বয়সের সঙ্গে প্রয়োজন বুঝে ব্যায়াম, শরীরের যত্নে, পোশাক ও খাওয়াদাওয়া বেছে নিতে হয়। কোন বয়সে কী করা উচিত তার ধারণা দিলেন মোহসীনা লাইজু
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরেরও প্রয়োজন সঠিক ফিটনেস ও ডায়েট প্ল্যান। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি ঠিকমতো ওয়ার্কআউট করা যায়, তাহলে বয়স বাড়লেও শরীর ফিট থাকে। বার্ধক্য ঘিরে ধরতে পারে না। সঠিক ফিটনেসের জন্য প্রয়োজন ব্যায়াম, ডায়েট এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নে নেওয়া। তিরিশের পর থেকেই ধীরে ধীরে মাসল ক্ষয় হতে থাকে। যারা সারা দিন বসে কাজ করেন, কায়িক শ্রম একেবারেই হয় না তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও বেশি। শরীরের পেশি যত বেশি ব্যবহার হবে ততই পেশির ফাইবার ও শক্তি বাড়বে। তাই সুস্থতার জন্য প্রয়োজন ব্যায়াম করা। সব বয়সে সব ধরনের ব্যায়াম সবার জন্য প্রযোজ্য না।
চল্লিশ পেরোলে…
চল্লিশের পর অনেক নারীরই হাঁটুতে ব্যথা শুরু হয়। সে ক্ষেত্রে পায়ের জোর বাড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন ফিটেড লেগ এক্সটেনশন, লেগ প্রেস ইত্যাদি। কোমরে ব্যথা থাকলে কোর এক্সারসাইজ করা যায়। এ ছাড়া একটা বয়সের পর ডায়াবেটিস, হাই কোলেস্টেরল, হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। এ সময় অনেকেই সহজ সমাধান হিসেবে হাঁটা বা জগিং বেছে নেয়। কিন্তু বেশি হাঁটা হাঁটুর জন্য ভালো নয়। কারণ বেশি হাঁটলে হাঁটুর বন্ধনীর অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ওভার ইউস ইনজুরি হয়, যার থেকে আর্থ্রাইটিসের সম্ভাবনা বাড়ে। তবে নিয়ম মেনে হাঁটা এবং জগিং শরীরের জন্য খুবই উপকারী। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন ২০-২৫ মিনিট হাঁটুন। পায়ের সমস্যা থাকলে সাইক্লিং বেছে নিতে পারেন। সাইক্লিংয়ে শরীরের অনেকটা ওজন সিটের ওপর থাকে বলে হাঁটুর ওপর কম চাপ পড়ে। এ ছাড়া সাঁতারও খুব ভালো অপশন। সাঁতারে মাসল কিংবা জয়েন্টের ওপর খুব চাপ পড়ে না। এ ছাড়াও করতে পারেন যোগাসন। ভুজঙ্গাসন, ধনুরাসন, জানুশিরাসন, উষ্ট্রাসন কোমর এবং হাঁটুর নমনীয়তা বাড়ায়। জয়েন্ট পেন কমাতে সাহায্য করে। তা ছাড়া যোগাসন মনকে শান্ত ও ভালো রাখতেও উপকারী। এর পাশাপাশি ঘুমের আগে কিছুটা সময় রাখুন রিল্যাক্সেশনের জন্য। ঘুমানোর আগে আধা ঘণ্টা বই পড়ুন, গান শুনুন বা মিনিট পনেরো হাঁটুন। এতে মন শান্ত হয় এবং ঘুমও ভালো হয়। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন। ঘুমের সময় শরীরে বিভিন্ন ঘাটতি পূরণ করার কাজ করে। ভালো ঘুম শরীরকে তরতাজা করে তোলে।
পঞ্চাশ পেরোলে…
পঞ্চাশের পর নারীদের ব্যায়ামে পরিবর্তন আনতে হয়। শরীরে নানা রকমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেকের ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হন। পাশাপাশি দেখা দেয় ওবিসিটি। তাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ব্যায়াম নির্বাচন করতে হবে। এ বয়সে অনেকেরই অবসাদ ঘিরে ধরে। ব্যায়ামের পাশাপাশি অনেকটা গুরুত্ব দিয়ে হবে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি। ব্যায়ামের পাশাপাশি সময় দিন রিল্যাক্সেশনের জন্য। ব্যায়াম করার সময় ঘরে গান চালিয়ে দিন, হাঁটার সময় হেডফোনে গান শুনুন। এতে হাঁটতে ভালো লাগবে। আসলে আপনি যেই কাজই করুন না কেন, সেখানে আনন্দ খুঁজে পাওয়া খুব জরুরি।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা
চল্লিশোর্ধ্ব মহিলাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হলে প্যাপ স্মেয়ার। এই পরীক্ষা সার্ভিক্যাল ক্যানসারের ঝুঁকি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। চল্লিশ পেরোলে এই পরীক্ষা দু-তিন বছরে একবার করা খুবই জরুরি। এ ছাড়া অনেক নারীর মুখোমুখি হতে হয় থাইরয়েড সমস্যায়। কেউ হাইপোথাইরয়েডিজমে ভোগেন আবার কেউ হাইপারথাইরয়েডিজমে। পা ফোলা, হাত পা ও জয়েন্টগুলোতে ব্যথা থাইরয়েড সমস্যার সাধারণ উপসর্গ। স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা বিশেষত চল্লিশোর্ধ্ব মহিলাদের মধ্যে অনেক বেশি। তাই স্তন ক্যানসার প্রতিরোধ করার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হলো হরো ম্যামোগ্রাম পরীক্ষা। বয়স বাড়ার সঙ্গে হাড়ের ক্ষয় শুরু হতে থাকে। চল্লিশের পরে হাড়ের ঘনত্বের পরীক্ষা, হৃদযন্ত্রের পরীক্ষা ও হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। নিয়মিত চেকআপে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট প্রতিরোধ করা যায়। নারীদের মধ্যে ওভারিয়ান ক্যানসার বেশিরভাগই মনোপজের পরে দেখা যায়। তাই ওভারিয়ান ক্যানসারের ঝুঁকি এড়াতে মনোপজের আগেই নির্দিষ্ট পরীক্ষা করা উচিত। চল্লিশোর্ধ্ব নারীদের ভিটামিন ডি-এর বেশি প্রয়োজন, যা ক্যালসিয়াম শোষণ করে এবং হাড়ের ক্ষয়রোধ করে। তাই ভিটামিন ডি-এর মাত্রা পরীক্ষা করা খুবই প্রয়োজন। এসময়ে টাইপ-টু ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হন। শরীর গ্লুকোজের সমতা বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না, তাই ডায়াবেটিস হয়েছে কিনা জানতে প্রতি ছয় মাস পর পর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা জরুরি। উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় এই সময়ে। তাই চল্লিশে পৌঁছলেই নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তচাপের অবস্থা জানা দরকার। বয়সের সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। দৃষ্টি ঝাপসা এবং চোখ শুষ্ক হতে আরম্ভ করে। ছানি বা গ্লুকৌমা ক্রমে দেখা দিতে পারে আর তাই চল্লিশ পেরোলেই নিয়মিত চোখের পরীক্ষা ভীষণ জরুরি।
খাবারদাবার
চল্লিশ পেরোলেই চর্বিযুক্ত মাংস, ডিম খেতে হবে পরিমিত পরিমাণে। রুটি, ভাত, আলুÑ এসব কার্বোর সঙ্গে চর্বিযুক্ত মাংস এবং ডিম, মাছ এগুলো খাওয়া যাবে না। যখনই শর্করার সঙ্গে এসব খাবার খাওয়া হবে তখনই সমস্যা সৃষ্টি করবে। ব্রেনও চর্বিতে ভরপুর হবে। শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়া কমিয়েদিতে হবে। বাদাম, মাখন, দুধ এসব খেতে হবে। সন্ধ্যা ৭-৮টার মধ্যে রাতের খাবার খাবেন। দুপুরে খাওয়ার পর বিশ্রাম নেবেন কিন্তু ঘুমাবেন না। সামুদ্রিক মাছ খেতে পারেন। অলিভ অয়েল দিয়ে খাবার রান্না করা খাবার খেতে পারেন। শরীরের চাহিদা বুঝে পানি পান করুন।
যেমন পোশাক ও সাজ
নারী হিসেবে আপনি কেমন পোশাক পরবেন তা নির্ভর করে মূলত রুচি, স্থান ও ঋতুর ওপর। কর্মজীবী নারীর পোশাক অন্যদের থেকে আলাদা হবে। আর গৃহিণী নারীর পোশাক হবে অভ্যস্ততা, ঘরের পরিবেশ ও আরামের বিষয়টাকে প্রাধান্য দিয়ে। কর্মজীবী নারীদের জন্য সালোয়ার কামিজের বাইরে বিভিন্ন ধরনের বিজনেস প্যান্ট পরতে পারেন। সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের শার্ট বাছাই করা যেতে পারে। সচেতন থাকতে হবে কাটিং ও ডিজাইনের বিষয়ে। সাধারণত লম্বা স্লিভের শার্ট কর্মস্থলের জন্য উপযোগী। করপোরেট অফিসের পোশাক হিসেবে ফর্মাল শার্ট ও প্যান্ট কিংবা বিজনেস স্যুট মানানসই। পোশাক নির্বাচনের সময় মনে রাখতে হবে যেন আরামদায়ক হয়, যাতে করে সারাদিন ধরে কাজ করা, ওঠা ও বসায় সমস্যা না হয়। অফিসে কাজ করা নারীদের ক্ষেত্রে একটু ঢিলেঢালা ফিটিংসের প্যান্ট, টপস, শার্ট নির্বাচন করা ভালো। কিংবা জিনস লেগিংস দিয়ে ওয়ান পিস পরা যায়। এসব ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে নারীরা সালোয়ার-কামিজ ব্যবহারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। পাশাপাশি রয়েছে হালকা রঙের সুতি, তাঁত, কোটা, পাতলা কাজের সিল্ক বা জর্জেট শাড়ি। আর যেসব নারী ঘরে
থাকবেন তারা টি-শার্ট, ট্রাউজার, সালোয়ার-কামিজ, ম্যাক্সি, মিডি এসব বেছে নিতে পারেন। পোশাকের বিষয় যেটা খেয়াল রাখতে হবে চলিশোর্ধ্ব পর অধিকাংশ নারীদের গরম বোধ করার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই এমন ধরনের ফেব্রিকস বেছে নিতে হবে, যাতে অনেক গরমেও আরাম হয়। এ সময় নিজের ত্বক ও চুলের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। অনেকের বলিরেখা দেখা দিতে শুরু করে। মুখে দাগ, মেছতা দেখা দেওয়ার প্রবণতা হয়। চুল সাদা হয়। তাই চুলে হেনা কিংবা কালার করা প্রতি মাসে একবার জরুরি। ত্বকের যত্নে প্রতিদিন ত্বক ভালো করে ক্লিনজার দিয়ে পরিষ্কার করা, ময়েশ্চারাইজার দেওয়া। সপ্তাহে দুদিন ফেসপ্যাক দেওয়া, মাসে একবার ফেসিয়াল করা যেমন জরুরি। তেমনি প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নাইট ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। হাত ও পায়ের যত্নে মাসে অন্তত একবার পেডিকিউর ও মেনিকিউর করাও দরকার।