
নীলাভ মিষ্টি আলোতে ভরপুর থিয়েটার হলটি। উপর থেকে নীচ পর্যন্ত নেমে এসেছে বেশ চওড়া চওড়া কয়েকটি স্তর। প্রতিটি স্তরে সুন্দর করে সাজানো রয়েছে গোল গোল ছোট টেবিল আর বেতের চেয়ার। যার যেখানে ইচ্ছে হচ্ছে বসছে। আমরাও আমাদের সুবিধা মতো একটি টেবিল নিয়ে বসলাম। পেছনে ড্রিংকস বার। একটি সুন্দরী মেয়ে ঘুরে ঘুরে সবার কাছ থেকে অর্ডার নিচ্ছে। সামনে বিশাল উজ্জ্বলমঞ্চে দাঁড়িয়ে স্প্যানিশ ভাষাতে গান করে যাচ্ছে ঝলমলে পোশাক পরা মিষ্টি কণ্ঠের একজন সুশ্রী গায়িকা। তার পোশাক দেখে মনে হচ্ছিল আকাশের হাজার তারা নেমে এসেছে আজ এই মঞ্চে। মঞ্চের দুই পাশে আধুনিক বাদ্য যন্ত্রের সাথে অতান্ত্য সুন্দর করে বাদ্য যন্ত্র শিল্পিরা ছড়িয়ে যাচ্ছে তাদের সুরের মহিমা।
গানের শেষে এবার নৃত্যর পালা। একঝাক তরুন তরুণী গান ও বাদ্য যন্ত্রের তালে তালে মঞ্চে প্রবেশ করলো। তরুণীরা অত্যান্ত স্বল্প বস্রে নিজেদের সাজিয়েছে। যত টুকু একেবারে না পরলেই না ঠিক ততটুকুই তারা পরিধান করেছে। সে স্বল্প পরিধান টুকুও সাজিয়েছে নানা রঙে। মাথায় ঝলমলে টুপি। পায়ে পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি উঁচু হিল জুতা। তালে তালে উদ্যম গতিতে নেচে যাচ্ছে তরুন তরুণীরা। তরুণীদের দেহ পলব দেখে মনে হচ্ছিল সৃষ্টি কর্তা বিশেষ কারিগর দিয়ে ওদের দেহ পলবগুলো সৃষ্টি করিয়েছেন। ওদের শরীরগুলো মনে হচ্ছে স্প্রিং দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যা করতে চাচ্ছে তারা, তাই হচ্ছে কোন হার মাংশ মনে হচ্ছে নেই তাদের শরীরে। একদল নাচ শেষ করে যাচ্ছে আরেক দল ঢুকছে। কিছু কিছু নাচের মেয়েকে আমার কাছে সার্কাসের মেয়েদের মতো মনে হচ্ছিল। নৃত্য শিল্পীদের পরিধান স্বল্প থেকে স্বল্পতর হচ্ছে । সাথে সাথে আমার হৃদ যন্ত্রের গতিও বাড়তে থাকলো । কি জানি তারপরে কি হতে যাচ্ছে । মনে মনে বললাম ‘হে ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করো’। এর চাইতে বাড়াবাড়ি কিছু হলে আমার চোখ বন্ধ করে রাখতে হবে, এমন একটা ভাব যেনো আমি কিছু দেখতে না পেলে কেউই কিছু দেখবে না। নাহলে বার হয়ে যেতে হবে হল থেকে। প্রথমটাই করতে হবে। দ্বিতীয়টা মনে হোল একটু অশোভন হয়ে যাবে । নাহ আমার কিছুই করতে হলো না। নাচের শিল্পীরা তাদের কিছুটা শালীনতা বজায় রেখেছিলো।
নানা রকম নৃত্য পরিবেশিত হোল দুই ঘণ্টা ধরে। আমার একটা চিন্তা মাথায় চেপে বসলো এবং সাথে সাথে মেয়েগুলোর জন্য বেশ কিছুটা মায়াও অনুভব করতে লাগলাম। মনে হোল আহারে মেদহীন শুধু চামড়া দিয়ে গড়া স্প্রিং এর মতো দেহটা বজায় রাখতে কতদিন হয়তো পেট পুরে আরাম করে খেতে পারে না মেয়েগুলো, একটু আরাম করে দুপুর বেলা গড়াগড়ি দিয়ে একটু দিবানিদ্রাও নিতে পারে না। নিলেইতো সব শেষ। ইশ এতো উঁচু হিল পরে লাফা লাফি করে নিশ্চয়ই পায়ের ব্যথাতে মরে যাচ্ছে। ওদের পা দুটোর যতœ করার লোক নিশ্চয়ই আছে। পয়সা রোজগারের জন্য কত কষ্ট মানুষের। কি করবো আমি? আমি এমন একজন নারী যে কিনা একালে বাস করেও কিছু কিছু ব্যাপারে সেকেলে চিন্তা মাথায় ঘুরে। আমার যে সেকেলে চিন্তা ভাবনা করতেই ভালো লাগে।
শো শেষ হলে ফিরে এলাম রুমে। আজকের দিনটি কাটালাম নানা রঙে নানা অভিজ্ঞতাতে। জানি না আগামী দিন গুলো কি ভাবে কাটবে। ভেবে নিলাম কাল সারাটা দিন সাগরের সাথে মিতালি করেই কাটাবো।
খুব সকালে কখনো উঠতে পারিনা। এখানে এসেও আমার একই অবস্থা। প্রথম দুই দিন খুব উৎসাহ নিয়ে মজার ব্রেকফাস্ট খাওয়ার জন্য সকালে উঠে রেস্টুরেন্ট গেলেও আর যাইনি। আমার স্বামী প্রতিদিন যায় পছন্দ মতো ব্রেকফাস্ট খাওয়ার জন্য আর আমি আরাম করে ঘুম থেকে উঠে রুম সারভিছ নিচ্ছি। এটাই আমি। প্রতিদিন সূর্য অস্ত দেখলেও কতদিন সূর্য উদয় দেখিনা সেটা স্মৃতিতে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো সকাল আটটাতে ক্লাসে যেতে পারিনি। সকালে উঠতে হবে বলে কখনো সকালের ফ্লাইট নেইনি। সকালে উঠতে পারিনি বলে জীবনে অনেক সুন্দর জিনিষ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তবুও আমি আমার এই অভ্যাসটি নিয়েই মহা আনন্দে বেঁচে আছি। আজো রুম সারভিছ ব্রেকফাস্ট খেয়ে তৈরি হলাম সাগর সৈকতে দিন কাটাবার জন্য।
ম্যাল্টন, কানাডা