
নামটি আমারই দেয়া। মূল শব্দ নিলীন বা নিমগ্ন। নীলনের জন্ম হবার কিছুদিন আগে চাকুরীর ট্রেনিং নিতে ওর বাবা বিদেশে চলে গিয়েছিল। নীলনের মা অর্থাৎ আমার ছোট বোন রুনি তখন আমাদের বাসাতেই থাকত। কাজেই ডাক্তার ওয়াদুদ এর ক্লিনিক থেকে সরাসরি নানার বাড়িতে এসেছিল নীলন। আমি ওর একমাত্র মামা। নীলনের বড় চাচা ওর নাম দিয়েছিল সোহেল। সোহরাব হোসেনের ছেলে সোহেল হোসেন। কাজেই দাদার বাড়ীর সকলের মুখে সোহেল আর নানা বাড়ির সকলের কাছে সে ছিল নীলন। এভাবেই নীলনের গল্পের শুরু।
একটি শিশুর মৃত্যুতে আমাদের পরিবার মর্মাহত। আটচল্লিশ বছর আগে যেমন শিশু হয়ে নীলন জন্ম নিয়েছিল ঠিক শিশুর মতোই সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল দুই সপ্তাহ আগে। নীলন কখনো মাঠে গিয়ে কারোর সাথে খেলা করেনি। তার কোন বন্ধু হয় নি। সে কারণে তার কোন শত্রুও নেই। নীলন কোনদিন কোন অপরাধ করেনি, কারোর সাথে ঝগড়া ঝামেলা এসবে জড়ানোর কোন সুযোগ ছিল না তার। নীলন কথা বলতে পারত না। ও ছিল একজন স্পেশাল চাইল্ড।
কিছু কিছু অস্বাভাবিক লক্ষণ ওর ছোট বেলা থেকেই দেখা দিয়েছিল। সারারাত কাঁদত তাও চীৎকার করে। আম্মাকে দেখতাম নীলনের নাভির গোঁড়ায় গরম ছ্যাঁক দিতেন। অনেকদিন পর্যন্ত রাতের বেলায় নীলনের রুমে একটি গরম তাওয়া দেখেছি। পেট মালিশ করা, পানি পড়া, হোমিওপ্যাথিক এলোপ্যাথি নানান চিকিৎসা করানো হয়েছিল। মাঝে মাঝে ভাল তো কিছুদিন পরেই ফিরে আসত অজানা সেই কষ্ট। না না আমাদের কষ্ট নয়, ওর যে কী কষ্ট হতো তা সে বলতে পারতো না। অথচ একটু বড় হয়ে যখন হাঁটি হাঁটি পা পা কিংবা আরেকটুকু বড়, তখন বাসার ছাদে ওকে বল এগিয়ে দিলে কিক করে বলত ‘বল’।
ট্রেনিং এর পর নীলনের বাবার প্রথম পোস্টিং হয় প্যারিসে। বিদেশে যাচ্ছে যখন তখন নীলনের ভালো চিকিৎসা হবে সেটাই আশা করেছিল সকলে। কিন্তু হলো উল্টো। শুনেছি এক চিকিৎসক এবং তার ভুল ওষুধের কারণে দিনে দিনে সে নিস্তেজ হয়ে বসে যেতে লাগলো। আমিও একবার গিয়েছিলাম প্যারিস। ওর সাথে একই বেডে ঘুমতাম। অনেকক্ষণ লাগতো ওকে ঘুম পড়াতে। পাশাপাশি বালিশে শুয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসত। ছেড়ে দিলেই ছটফট করবে তাই চেপে রাখতাম বুকের সাথে। এমন অবস্থায় জোড়ে জোড়ে আমার মাথার চুল টেনে মুক্তি চাইতো। মাঝে মাঝে একা একাই হাসত। নীলনকে ঘুম পড়ানোর শেষের দিকে দুই পায়ের মাঝখানে ওর ছোট্ট পা দুটো চেপে রেখে ক্লান্ত করে দিতাম। এমন পরিস্থিতিতে ডাগর ডাগর চোখে আমার দিকে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে সে চেয়ে থাকতো। আমি ঘুমন্ত অবস্থায় ওর কোঁকড়ানো চুলে হাত বুলিয়ে বলতাম – একদিন তোমার মুখে নিশ্চয়ই মামা ডাক শুনবো।
না, সেটা আর হয়ে ওঠেনি। বড় হতে লাগলো আর নিঃসঙ্গ নিস্তেজ নীলন নিজস্ব ভুবনে ঢুকে গেল। অথচ এই নীলনই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিল আমাদের পরিবারের মধ্যমণি। কেউ ওদের বাসায় গেলে প্রথমেই চলে যেত নীলনের রুমে। দু’এক মিনিট ওকে সময় না দিয়ে সোফাতে গিয়ে কেউ বসতো না। দু’বছর আগে বাংলাদেশে গিয়ে রুনির বাসায় থেকেছি বেশ কিছুদিন। রাতে কিংবা দিনে নীলন একটা কাশি দিলেই আমার স্ত্রী দৌড়ে যেত ওর রুমে। গিয়ে বলতো নীলন সোনা কিছু লাগবে? দেশে কিংবা বিদেশে প্রতিদিন ওর বাবা ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করতো নীলন কিছু খেয়েছে? নীলন কি ঘুমিয়ে পড়েছে? বাড়ির বাইরে থাকলে কিছুক্ষণ পর পর ফোন করে রুনি নীলনের খোঁজ নিত। জিজ্ঞেস করতো ওর ওষুধটা দিয়েছিস। নেবুলাইজার লাগবে। সিজার হয়েছে? নীলন দেশের জন্য কিছুই করতে পারেনি তবুও ওর নামে একটা পাসপোর্ট আছে। ওর বাবা হাই কমিশনার কিংবা এম্বাসেডর হয়ে যেসব দেশে গিয়েছে অথবা বাংলাদেশ মিশনে যেখানেই বদলি হয়েছে নীলন সেসব দেশের আলো বাতাস উপভোগ করেছে। ওর দেখা বিদেশের গল্প যদি লিখে যেতে পারতো তাহলে আমরা হয়তো একটি সাদা লেখা পেতে পারতাম।
একটি ছোট্ট ঘটনা বলছি। খবর পেলাম নীলনের হাঁটতে কষ্ট হয়। সে পায়ের ওপর ভর দিয়ে হাঁটতে পারে না। আব্বা আম্মা তো নাতীর জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন। সে কী? বিদেশে গিয়েও কোন উন্নতি হলো না! নাতীর জন্য বাংলাদেশের নানা নানী, দাদা দাদীর অস্থির হবার পাগলামি তো সবারই জানা। কাজেই আমাদের বাসাতেও তার ঢেউ এসে লাগল। মোহাম্মদপুর বসিলা থেকে তুলা রাশির এক লোক নিয়ে ঝাড়ফুঁক করা হুজুর এলেন বাসায়। আম্মার কত গচ্ছা গিয়েছিল তা কখনো জানা হয়নি তবে বড় একটা দান মেরে দিয়েছিলেন সেই হুজুর তা বুঝতে পেরেছিলাম। বাসার সমস্ত বাতি বন্ধ করে জীন আনা হলো। হুজুরের লাঠির আঘাতে তুলা রাশি লোকটা দাঁড়ান অবস্থা থেকে ধরুম করে মেঝেতে পড়ে গেল। একের পর এক প্রশ্ন করে হুজুর জিনের ঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছেন। নীলনের দেশে তখন দিন। অর্থাৎ আমাদের সময়ের বিপরীত। আমি জিজ্ঞেস করলাম নীলন এখন কোন ঘরে? কেননা আমি ওর ঘরটা চিনি। হুজুর তার লাঠিতে তেল মেখে মেখে বিদেশে অবস্থানরত নীলনের পায়ে হাঁটার শক্তি এনে দিয়েছেন এমন সত্য জাহির করার জন্য বললেন এইতো হেঁটে হেঁটে ওর নিজের ঘরে গেল। আমি বুদ্ধি করে জিজ্ঞেস করলাম এত অন্ধকারে একা একা হেঁটে গেল? হুজুর বললেন অন্ধকার তো এই বাসায়। ওদের বাসার সব লাইট জ্বালানো। দিনের বেলায় লাইট! আচ্ছা দেখা যাক। আমি বললাম কালো গরুর দুধ খেলে নীলন ভালো হয়ে যাবে এমন কথা বলেছিলেন অন্য এক হুজুর। তাই ওর বাবা একটা কালো গরু কিনেছে। দেখেন তো গরুটা ঠিক আছে কিনা। হুজুর নুঁই সুঁইর সেন অর্থাৎ সেন নদীর পাড়ে অবস্থিত প্যারিসের ডিপ্লোম্যাটিক পাড়ায় একটা কালো গরু দেখতে পেলেন। গরুর আনুমানিক দুধের পরিমাণও বলে দিলেন। গরুটি তখনো খড় চিবুচ্ছে এবং তাকে দেখাশুনা করা রাখাল ছেলেটাও খুব উপযুক্ত সেটাও ভিডিও কলের মতো দেখতে পেলেন। ধৈর্য ধারণ করতে না পেরে জিনের সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে অন্য ঘরে চলে গেলাম। আম্মা তবুও বিরক্ত হলেন না। এতসব মিথ্যাবাজির মাঝেও যদি নীলনের কিছু ভালো হয় সেই আশায়।
নীলনের মা অর্থাৎ আমার ছোট বোনকে গেল শনিবার বললাম। নীলনের অনেক বড় ভাগ্য যে তোর আর সোহরাবের মতো বাবা মায়ের ঘরে জন্ম নিয়েছিল। অবহেলা কী জিনিস সেটা সে কখনো অনুভব করেনি। বরং মনোযোগ শব্দটি তার ঝুলিতে শতভাগ জমা আছে। কাজেই নীলনের বিদায়ে কষ্ট না পেতে। এই চলে যাওয়া মানে আদর স্নেহের সবটুকু মাখিয়ে কাউকে উড়ে যেতে দেওয়া। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আমাদের উৎকণ্ঠা ছিল নীলনকে নিয়ে। প্রথমে আইসিইউ পরে লাইফ সাপোর্ট পরে কিছুটা সুস্থতা এবং শেষে ক্যাবিনে থাকা অবস্থায় চিরবিদায়। কোন মন্ত্রী নয়, কোন ব্যবসায়ী নয়, কোন শিল্পপতি কিংবা শিল্পীও নয়। তবু্ও ঢাকার জাপান হাসপাতাল ওকে যে সেবা দিয়েছে সেটার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নীলনের দোয়ার পর হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় নার্স থেকে শুরু করে ডাক্তারদের জন্য আমার বোন খাবার পাঠিয়েছে। সাধারণত আমরা ভুলে যাই অসহায় অবস্থায় আমাদের আপনজনকে কারা সেবা দেয়। কে তাকে উঁচু করে বসায়, কে দেয় গা মুছে। ভুলে গেলে ভুলে যাওয়া যায়। আবার কখনো সখনো তাদের সাথে দেখা করে খোঁজ খবর নিয়ে আসা সেটাও অন্য রকম বন্ধন। আমরা প্রায়ই শুনি একদিন সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ পেতে হবে। আমি বলি, কাউকে না কাউকে একদিন হাসপাতালে যেতেই হবে। কাজেই হাসপাতালের জন্যও কিছু নেক কাজ করা দরকার। যেমন দরকার গোরস্তানের কর্মচারীদের জন্য। তারাই যত্ন করে যাদের আমরা স্পর্শের বাইরে রেখে আছি তাদের। ঢাকায় গেলে তাই এখনো বাবুলের সাথে গিয়ে দেখা করি। আর সে দেখাশোনা করে আব্বা আম্মা বড় বোন এবং ছোট বোনের স্বামীকে। এখন থেকে বাবুলের অতিরিক্ত আরেকটি দায়িত্ব বেড়ে গেল। এখন ওর তালিকায় নতুন নাম – নীলন।
স্কারবোরো, কানাডা