
সাঁঝের জন্য অপেক্ষা করতে করতে হাল ছেড়ে দিয়ে নিদ্র ওর রুমে চলে যায়।ফোন হাতে নিতেই ওর বন্ধু লিমনের অনেকগুলো মিসডকল দেখে চিন্তিত হয়ে কলব্যাক করে।তখনি লিমন জানায় ওর মায়ের অবস্থা ভালো না।ইমিডিয়েটলি অপারেশন করতে হবে।তিন ব্যাগ র’ক্ত লাগবে।দুই ব্যাগ ব্লাড ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করা হলেও আরো একব্যাগ লাগবে।নিদ্রর ব্লাডগ্রুপ সেম হওয়ায় লিমন ওকে কল করে হসপিটালে আসতে বলে।
বেচারা অনেক কান্নাকাটি করছিলো।নিদ্র বিনাবাক্যে হ্যাঁ বলে দেয়।কাউকে কিছু না জানিয়ে হসপিটালে চলে যায়।তাই বাড়ির কোনো কিছুই নিদ্র জানে না।
“এসব কী হচ্ছে! ”
নিতা দৌড়ে গিয়ে ছেলের হাত ধরে টানতে টানতে রুমে নিয়ে যায়।দরজা চাপা দিলে নিদ্র প্রশ্ন করে,”কী করছ আম্মু? আর বাইরে এসব কী হচ্ছে? সাঁঝ লাল শাড়ি পড়ে আছে কেন?আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না।”
নিতা ছেলেকে বিছানায় বসিয়ে গা ঘেঁষে বসে হাত চেপে ধরে বলে,”দ্যাখ নিদ্র তুই এইসব ঝামেলায় পড়বি না।আল্লাহ রক্ষা করছে তুই বাড়িতে ছিলি না।তুই জানিস ঐ সাঁঝ কীভাবে নিভ্রাণকে ফাঁসিয়েছে।”
“কীসব বলছ!”
বিস্মিত নিদ্র।মা’য়ের কোনো কথাই ওর বোধগম্য হচ্ছে না।
“ঠিকই বলছি।”
এরপর নিতা নিদ্রকে রাতের সকল ঘটনা বিস্তারিতভাবে বলে।অবশ্য একটু বেশিই বানিয়ে বলেছে।যেমন নিভ্রাণ সাঁঝকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখা গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি ।
নিদ্র গর্জে উঠে নিতাকে থামিয়ে দেয়।রাগান্বিত গলায় বলে,”তোমার মাথা ঠিক আছে আম্মু! তুমি সাঁঝকে নিয়ে কীসব বাজে বকছ।আর যতই ভাই বিদেশ থাকুক না কেন।ভাই কখনো খারাপ হতে পারে না।আমি বিশ্বাস করি না।আর সাঁঝ তো আমার,,”
আমার জন্য স্টোররুমে গিয়েছিল কথা বলতে পারল না।তার আগেই নিতা ওর মুখ চেপে ধরে সর্তকিত গলায় বলে,”চুপ,চুপ।যা হচ্ছে হতে দে।আমি আগে থেকেই জানি ঐ মেয়ে তোকে বশ করেছে।ভাবি তো এটাই চেয়েছিল।এখন নিজের ছেলের বেলায় ফেঁসে গিয়ে বাধ্য হয়ে বিয়েটা দিতে হচ্ছে। তুই এই বিষয়ে একটা কথা বলবি না নিদ্র।”
“অসম্ভব। এতবড় অন্যায় আমি কিছুতেই হতে দেব না।আমি এখনি যাচ্ছি। এই বিয়ে হবে না,কিছুতেই না।”
নিদ্র যেতে লাগলে নিতা চেঁচিয়ে বলে,”যা গিয়ে বিয়ে ভেঙে দে।তারপর যখন তুই ফিরে আসবি তোর মায়ের ম’রা মুখ দেখবি।”
নিদ্র পেছন ঘুরে আহত গলায় ডেকে ওঠে,”আম্মু!”
নিতা বা-হাতের কব্জিতে চা’কু ধরে রেখেছে।নিদ্রকে শাসিয়ে বলে,”তুই যদি বিয়েটা না হতে দিস তাহলে এখনি আমি নিজেকে শেষ করে দেব।”
“এতবড় কঠিন পরীক্ষায় আমাকে ফেল না আম্মু। এরপর আমি নিজেই নিজের চোখে ছোট হয়ে যাব।”
নিতা কেঁদে ওঠে বলে,”তুই আমার একমাত্র ছেলে নিদ্র। তোর আব্বু ভবঘুরে মানুষ। আমি তোকে সম্বল করে বেঁচে আছি।তুই বড় হবি।অনেক নাম কামাবি।আমি মানুষের কাছে গর্ব করে বলব আমি তোর মা।তারপর তোকে ভালো ঘর দেখে বিয়ে দেব।তোকে নিয়ে আমার অনেক আশা নিদ্র।ঐ সাঁঝের পেছনে ঘুরে আমি কিছুতেই তোর ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে দেব না।এখন তুই ভাব তুই কী করবি।তোর মা চাই না কি সঁঝ।”
নিদ্র ওখানেই ধপ করে বসে পড়ে।শরীর অসার হয়ে আসছে।ও কখনো ভাবে নি এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে যেখানে ভালোবাসা আর মায়ের মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে।
নিদ্র কোনো জবাব দিচ্ছে না দেখে নিতা কব্জি বরাবর আস্তে করে টান দেয়।আর্তনাদের শব্দে নিদ্র দৌড়ে গিয়ে মা’য়ের হাত থেকে চা’কু ফেলে দেয়।ধমকে বলে,”পাগল হয়ে গেছ তুমি!”
তাড়াহুড়ো করে ফাস্ট এইড বক্স বের করে হাতে ব্যান্ডেজ করতে থাকে।
“তুই আমার কথা শুনবি তো বাবা?”
“আর কোনো উপায় রেখেছ?”
নিদ্রর আহত গলার স্বরে নিতা ভীত হলেও মনকে বোঝায় আবেগের বয়স সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।
উনি ছেলের মুখ আগলে কপালে চুমু খায়।হাসিমুখে বলে,”ড্রয়িং রুমে চল।”
——————————
সাঁঝ নিদ্রর অপেক্ষায় আছে।নিদ্রকে আসতে দেখে সাঁঝ খুশি হয়ে যায়।এই মুহূর্তে নিদ্রই পারে ওকে এই বিয়ে থেকে বাঁচাতে।
“নিদ্র ভাই।”
নিদ্র উত্তর দিচ্ছে না।ফ্যাকাশে মুখে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
নিতা আগ্রহ নিয়ে বলে,”কী হলো তাড়াতাড়ি বিয়ে পড়ান।রাত যে ভোর হয়ে এলো।”
চমকে ওঠে সাঁঝ।অবাক চোখে নিদ্রর দিকে তাকিয়ে থাকে।নিদ্রর কোনো হেলদোল নেই।কাজী আবারো সাঁঝকে কবুল বলতে বলে।সাঁঝ তখনো নিদ্রকে দেখেই চলেছে।কৈ নিদ্র তো একবারের জন্যও বলছে না এই বিয়ে হতে পারে না।সাঁঝ শুধু আমার।
“সাঁঝ কবুল বল।”
সাঁঝ নিদ্রর দিকে তাকিয়ে টলমল চোখে থেমে থেমে কবুল বলে।চোখ বন্ধ করতেই চোখের পানিটুকু বৃষ্টি হয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।
নিদ্র নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।সাঁঝের কবুল বলা ওর কানে গরম লাভা ঢেলে দেওয়ার মতো যন্ত্রণাদায়ক ছিলো।নিভ্রাণও চোয়াল শক্ত করে কবুল বলেই দুম করে উঠে রুমে চলে যায়।নিদ্র টালমাটাল পায়ে ঘরমুখো হয়।
পিছু পিছু নিতাও আসে।হাসি হাসি মুখ করে বলে,”সোনা ছেলে আমার।তুই চিন্তা করিস না।আমি তোর জন্য অনেক সুন্দর মেয়ে নিয়ে আসব।আর এমন তো না তোরা প্রেমিক প্রেমিকা।এক বাড়িতে থাকিস তাই মায়া জমে গেছে।দু দিন যেতে দে সব ঠিক হয়ে যাবে।এখন ঘুমিয়ে যা।অনেক রাত হয়েছে। ”
নিতা চলে যেতে লাগলে নিদ্র থমথমে গলায় বলে,”তুমি নিজেও জানো না আম্মু তুমি আমার জীবন থেকে কী কেড়ে নিলে।তুমি নিজ হাতে আমাকে জীবন্ত লা’শ বানিয়ে দিলে।ভালো ছেলে হতে গিয়ে খারাপ মানুষ হয়ে গেলাম।”
কথাগুলো নিতার কানে পৌঁছালো না।তার আগেই উনি প্রস্থান করেছেন।র’ক্ত দেওয়ায় এমনিতেই নিদ্রর শরীর দূর্বল ছিলো।তারওপর এতকিছু ঘটে যাওয়ায় ওর শরীর আর সায় দেয় নি।দরজা লাগিয়ে ঘুরতেই ফ্লোরে মাথাঘুরে পড়ে যায়।কষ্ট প্রকাশ করার সময়টুকু পেল না।
———————————
সাঁঝ পাথরের মতো হয়ে গেছে।চুপচাপ, না কথা বলছে আর না কান্না করছে।রিতু ওকে রুমে নিয়ে আসলে রূপন্তি রিতুকে চলে যেতে বলে।
“কিন্তু আম্মু সাঁঝ একা, ”
“আমি আছি।তুই তোর শ্বশুর শাশুড়িকে সামলা।”
“হুম।”
রিতু চাপা শ্বাস ফেলে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।আজ রাতুল উপস্থিত থাকলে হয়ত কিছু একটা করতে পারত।দুপুরের পরপরই অফিসের কাজে ওকে বাইরে যেতে হয়েছে।
রূপন্তি সাঁঝের পাশে বসে।ওর হাতটা ধরে অনুতপ্ত হয়ে বলে,”আমাকে মাফ করে দিস মা।তোর বিনা মর্জিতে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।”
সাঁঝ আফসোসের সুরে বলে,”তুমি কেন মাফ চাইছ মামণি!আমার তো কপালটাই খারাপ।কপালে যা ছিলো সেটাই হয়েছে।”
রূপন্তি আহত হলো।ব্যথাতুর চোখে তাকায় সাঁঝের দিকে।ওর ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।বুকের ভেতরে কষ্টের পাহাড় জমেছে।এতক্ষণ যার অপেক্ষায় ছিলো।সে এলো ঠিকই কিন্তু সাঁঝের জন্য নয়।নির্বাক দর্শক হতে এসেছিল সে।
নিদ্র না থাকলে সাঁঝ নিজেকে দোষ দিত।ওর বোকামি ধরে নিত।কিন্তু এখন দোষ কাকে দেবে?নিদ্রর হাতে তো সুযোগ ছিলো।সবার সামনে বলতে পারত সাঁঝ নিদ্রর সাথে দেখা করতে এতরাতে স্টোররুমে এসেছিলো।কিন্তু নিদ্র তা করে নি।নিদ্র নিজেকে বাঁচিয়েছে। সবচেয়ে প্রিয় মনুষ যখন ধোকা দেয় তখন ব্যথাটা একটু বেশিই হয় তাই না?
সাঁঝের মন ভেঙে গেছে।কেউ সম্মান বাঁচাতে ওকে কুরবান করেছে, তো কেউ নিজেকে বাঁচাতে। শেষ পর্যন্ত সবদিন থেকে হারটা সাঁঝেরই হলো।ভালোবাসায় চরম মার খেয়ে গেল সাঁঝ।
“মামণি আমার ঘুম পাচ্ছে তুমি যাও।”
“আজ আমি থাকি তোর সাথে।”
রূপন্তি ভয় পাচ্ছে দেখে সাঁঝ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,”চিন্তা করো না মামণি, ছোট্ট জীবনে অনেক পাপ করেছি,অনেক মানুষের অপ্রিয় হয়েছি।আত্মহত্যার মতো পাপ করে আল্লাহর অপ্রিয় হতে চাই না।মৃত্যু কখনোই কোনো কিছুর সমাধান হয় না।আমি দেখতে চাই আমার ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যায়।”
“মাফ করে দিস সাঁঝ।একদিন তুই আমাকে মাফ করবি মন থেকে আমার কাছে এসে বলবি আমি যা করেছি তোর ভালোর জন্য করেছি।আমার ছেলেকে আমি জানি।তোদের শুরুটা হয়ত আমৃত সমান হবে না।তবে যখন তোরা একে অপরকে চিনবি একে অপরকে পেয়ে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করবি।আমি সেইদিনের অপেক্ষায় থাকব।”
রূপন্তি উঠে গেলেন।এক পরাস্ত সৈনিকের মতো মুখ লুকিয়ে যুদ্ধ হইতে পলায়ন করলেন যেন।সাঁঝের চোখে চোখ রেখে কথা বলার মতো শক্তি বা মনোবল কোনোটাই ওনার মাঝে আর অবশিষ্ট নেই।
সাঁঝ দরজা আটকে ওয়াশরুমে চলে যায়।সবগুলো পানির ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে ধপ করে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে।আহাজারি করে কান্না করে।ওর কষ্ট কম নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে বেশি।রাগ মেটাতে ইচ্ছে মতো নিজেকে আঘাত করছে।চুল টেনে খুলে ফেলে,গায়ে থাকা যৎসামান্য গহনা খুলে ছুড়ে ফেলে দেয়।শাড়ি গা থেকে টেনে হিঁচড়ে খুলে ফেলে।ইচ্ছে মতো দু গালে থা’প্পড় মারতে থাকে।ঝরনার পানিতে ওর শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। লুকিয়ে ফেলছে সমস্ত আহাজারি, কান্না।
একটা সময়ের পর সাঁঝ ক্লান্ত হয়ে ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকে।
—————————
নিভ্রাণ শাওয়ার নিচ্ছে। উদম শরীরে পানির প্রতিটি কণা আছড়ে পড়ছে।ডান হাতটা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রাগের ঔষধ পানি,নিভ্রাণ রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে সেটাই করছে।তবুও পেরে উঠছে না।দেওয়ালে ইচ্ছে মতো ঘুষি মে’রে গায়ের জ্বালা মিটিয়ে নিচ্ছে।
রুমে আসার পরপরই সোহার কল এসেছিলো।সোহা আমেরিকায় গিয়েছে।কাজের সূত্রে ক’দিন ওখানেই থাকবে।ও জানে নিভ্রাণ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে।তাই কল করেছিল।
নিভ্রাণ সোহার কল দেখেও রিসিভ করে নি।কী বলবে ও?এই যে এই মুহূর্তে ওর বিয়ে হয়ে গেল!তাও একটা বিশ্রী ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
নিভ্রাণ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে বাথরোব পড়েই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।মস্তিষ্ক কাজ করছে না।যে করেই হোক এখান থেকে চলে যেতে হবে।এখানে আর এক মুহূর্তও নয়।সকাল হতেই নিভ্রাণ এখান থেকে চলে যাবে।