0.2 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ১৪, ২০২৫

নন-ক্যাথলিক কবরস্থান : সাহিত্যমোদীদের তীর্থস্থান

নন-ক্যাথলিক কবরস্থান : সাহিত্যমোদীদের তীর্থস্থান
নন ক্যাথলিক কবরস্থান সাহিত্যমোদীদের তীর্থস্থান

তীর্থ করে ফিরে এলাম সুদূর রোম থেকে। ইটালির রাজধানী রোমে অবস্থিত নন-ক্যাথলিক সিমেটরি বা প্রটেস্ট্যান্ট সিমেটরিটি ১৭১৬ সালে স্থাপিত হলেও, এখানে সাহিত্যমোদীদের ভিজিটেশন শুরু হয়েছে ১৮২১ সালে ইংরেজ কবি জন কীট্সকে (১৭৯৫—১৮২১) সমাহিত করার পর থেকে।

১৮২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয় কীট্সের জীবনের শেষ অধ্যায়। যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শয্যাশায়ী হলেন। রক্ত, লালা এবং নি:শ্বাসে যক্ষা রোগের জীবাণুধারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বিধায় ডাক্তার কীট্সকে আলাদা করে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে ফুস্ফুস্ থেকে রক্তক্ষরণ হয়েছে দু’বার। প্রতিবেশী ১৭ বছরের তরুণী ফ্যানী ব্রন (১৮০০—১৮৬৫) এই সময় কবির সাথে যোগাযোগ করতেন কাঁচের জানালার বাইরে থেকে এবং চিরকুট বিনিময়ের মাধ্যমে। ফ্যানীর চিঠির জবাবে রোগশয্যা থেকে লেখা কীট্সের ১৭১ শব্দের চিঠিটি ইতোমধ্যে ৯৬ হাজার পাউন্ডে নিলামে বিক্রি হয়েছে (দৈনিক গার্ডিয়ান, ৩০ মার্চ ২০১১), যেটি এখন লন্ডনের কীট্স যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে দর্শনার্থীদের জন্যে।

- Advertisement -

নন-ক্যাথলিক কবরস্থান : সাহিত্যমোদীদের তীর্থস্থান

তবে এই অন্ধকার বদ্ধঘরের মধ্যে থেকেও কবি দেখতে পেয়েছিলেন দু’টি মশালের আলো। এক, ডাক্তার বললেন, ১৮২০ সালের শীতকালটা ইংল্যান্ডের বাইরে গিয়ে কাটিয়ে আসতে। দুই, ব্রনের মা বললেন, কীট্স সুস্থ হয়ে ফিরে আসলে ১৮২১ সালে তিনি মেয়ের বিয়ে দেবেন তাঁর পছন্দের কীট্সের সাথে। ১৮২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর কীট্সের যাত্রার দিন ঠিক হলো।

কীট্সের বন্ধুরা তাঁকে জুনিয়র শেক্সপীয়র বলে ডাকতেন। আর কীট্স নিজেও ছিলেন উইলিয়াম শেক্সপীয়র (১৫৬৪—১৬১৬)-এর দারুণ ভক্ত। ইটালি যাবার মাস তিনেক আগে, জুন মাসে, এক ডিনার পার্টিতে কীট্সের সাথে দেখা হলে কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ (১৭৭০—১৮৫০) তাঁর কাব্য প্রতিভার প্রাণখোলা প্রশংসা করেন। কীট্স মেডিকেল পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে তাঁর শরীরের অবস্থা সম্পর্কে আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। এর-ই মধ্যে সতীর্থ ইংরেজ কবি পি বি শেলী (১৭৯২—১৮২২) এসে তাঁকে দেখে গেছেন।

নন-ক্যাথলিক কবরস্থান : সাহিত্যমোদীদের তীর্থস্থান

আগস্ট মাসের শেষের দিকে কীট্সের দ্বিতীয়বারের মতো রক্ত বমি হয়। ডাক্তারের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ব্রন এবার কীট্সের বিছানার পাশে বসে তাঁর হবু স্বামীর অনেক সেবাযত্ন করলেন। শুভ যাত্রার দিন ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। এতো কাছে পেয়েও কীট্সকে ছাড়তে হবে, ভাবতেই তাঁর নীল চোখে ধূসর জলের ধারা কেবল নিম্নমুখী হতে থাকে। সান্ ইসিদ্রো শহর থেকে রবীন্দ্রনাথকে দু’মাস সেবা দেয়ার পর বিদায় দিতে গিয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর (১৮৯০—১৯৭৯) চোখেও সেদিন নেমেছিল উষ্ণ ভালোবাসার শীতল ধারা।

১৮২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৭ তারিখ ইটালি যাত্রার দিন। সাথে যাচ্ছেন সদ্য একাডেমি গোল্ড মেডাল প্রাপ্ত কীট্সের বন্ধু তরুণ শিল্পী যোসেফ সেভার্ন (১৭৯৩—১৮৭৯)। বিষাদের ফাঁকে আনন্দের ধারা; ফ্যানীর শুধু মনে হয়, শ্রাবণের মেঘলা ছাদের ক্ষত চিহ্নের ফাঁক দিয়ে এ যেনো রবির লুকোচুরি খেলা।

ট্র্যাভেল ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছেন ব্রন নিজেই। কাগজ আর কলম আগেই ঢুকানো হয়ে গেছে, যাতে কীট্স হবু স্ত্রীর কাছে চিঠি লিখতে পারেন। সাথে দিলেন বন্ধু ইংরেজ কবি জন হ্যামিলটন রেনল্ড (১৭৯৪—১৮৫২)-এর কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া, ১৮০৬ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত, ‘দ্য পোয়েটিক্যাল ওয়ার্ক্স অফ শেক্সপীয়র’ গ্রন্থটিও। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে, শেক্সপীয়রের এই কাব্যসংকলনের ‘অ্যা লাভার’স কমপ্লেইন্ট’ কবিতার উল্টো দিকের একটি খালি পৃষ্ঠায় কীট্স লিখে রেখেছিলেন ব্রনকে নিয়ে লেখা সেই বিখ্যাত ‘ব্রাইট স্টার’ কবিতাটি। কীট্স তাঁর মৃত্যুর আগে বন্ধু সেভার্নকে এই কাব্যসংকলনটি দিয়ে গিয়েছিলেন।

কবির টুপিতে নিজের হাতে সিল্কের পাড় লাগিয়ে দেন ব্রন। দিলেন একটি ওভাল শেপের মার্বেল, যেটি ব্রন সেলাইয়ের কাজে ব্যবহার করতেন তাঁর হাত ঠাণ্ডা করার জন্যে। সাথে এক গোছা বাদামি চুল। বিনিময়ে তিনি নিজেও রাখলেন কবির এক গোছা।

নন-ক্যাথলিক কবরস্থান : সাহিত্যমোদীদের তীর্থস্থান

কীট্সের ইটালির পথে যাত্রা করার পর ব্রন নিয়মিত চিঠি লিখেছেন কবির কাছে। কিন্তু কীট্স বন্ধু সেভার্নকে বলেছেন তাঁকে ফ্যানীর কোন চিঠি না দিতে। রোমের যক্ষা হাসপাতালে গিয়ে তাঁর অবস্থা দ্রুত সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়লে, তিনি চাননি ব্রনের সাথে যোগাযোগ রেখে তাঁকে আর কষ্ট দিতে। কষ্টের মাত্রা এতোই বেড়ে গিয়েছিলো যে, মাঝে মধ্যে জ্ঞান ফিরলে তিনি চিৎকার করে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতেন, “আমি কেনো এখনো বেঁচে আছি!” কিন্তু জেগে ওঠার পর পর-ই খুঁজে বেড়াতেন ফ্যানীর দেয়া সে সাদা মার্বেলটি। তাঁর কাছে তখন পৃথিবীর সব কিছুই মিথ্যে, কঠিন পাথরটি-ই সত্য। তাঁর কাব্যে যেমন সুন্দরের আড়ালে সত্যের অবস্থান, পাথরের আড়ালেও ঠিক তেমনি করে হয়তো অনুভব করেছিলেন বাগদত্তার কোমলতা।

সর্বনাশা ১৮২০ সালের ডিসেম্বর পার হয়ে গেলো। ফ্যানী আশাবাদী ছিলেন, কীট্স আবার ফিরে আসবেন। ১৮২১ সালের ১৭ মার্চ ওয়েন্টওয়ার্থ প্লেসে খবর এলো, ২৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার, বন্ধু সেভার্নের কোলে মাথা রেখে বাগদত্তার প্রদত্ত সাদা পাথরটি ডান হাতের মুঠোয় চেপে কবি রওয়ানা দিয়েছেন যন্ত্রণা থেকে মুক্তির অন্বেষণে অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে।

রোমের প্রোটেস্ট্যান্ট সিমেটরীতে কীট্সকে সমাহিত করা হয়। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কফিনে যোগ করা হয় ফ্যানীর চুলের গোছা ও একখানা চিঠি, যে’টি কীট্সের পড়া হয়নি শবযাত্রার আগে। বন্ধু সেভার্নকে কবি অনুরোধ করেছিলেন তাঁর সমাধির গায়ে একটি লেখনি সংযোজন করতে –

“Here lies one whose name was writ in water.”

অর্থাৎ ‘এখানে যিনি শুয়ে আছেন, জলে লেখা তাঁর নাম’। জীবদ্দশায় ছায়ার মতো যিনি কবিকে অনুসরণ করেছেন, সুখে-দুঃখে পাশে থেকেছেন, সে অকৃত্রিম বন্ধু কীট্সের মৃত্যুশয্যার একমাত্র সঙ্গী জোসেফ সেভার্ন বন্ধু কীট্সের সমাধির গায়ে লিখলেন,
“This grave contains all that was mortal, of a young English poet, who, on his death bed, in the bitterness of his heart, at the malicious power of his enemies, desired these words to be engraved on his tomb stone “HERE LIES ONE WHOSE NAME WAS WRIT IN WATER.”
উল্লেখ্য, ১৮৭৯ সালে সেভার্নের মৃত্যু হলে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে কীট্সের সমাধির পাশেই সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধির গায়ে লেখা হয়,
‘The Devoted Friend and Death bed Companion’ of a man by then recognized as one of the ‘Immortal Poets’।

‘ওড টু নাইটিংগেল’ কবিতায় নাইটিঙ্গেল পাখির কাছে কীট্সের বন্দনা ছিলো—
‘মৃত্যুর জন্য তোমার জন্ম হয়নি, তোমার মৃত্যু নেই। তুমি অমর …।’
বিহঙ্গ বেঁচে থাকবে তার সঙ্গীতে। কবি বেঁচে থাকবেন তাঁর কাব্য প্রতিভায়। কীট্স আজ আমাদের মধ্যে বেঁচে থেকে প্রমাণ করেছেন, তিনিই ‘নাইটিঙ্গেল’।
রোমে বন্ধু সেভার্ন ও কীট্সের সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে আমিও উচ্চারণ করলাম, ‘Thou was not born for death, immortal bird!’

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles