
আজ থেকে ৩২ বছর আগের ঘটনা। এক মার্কিন অষ্টাদশী এলিয়েদা মের্কড লিয়া শরীরের সঙ্গে সাড়ে তিন কেজি হেরোইন বেঁধে ঢাকা বিমানবন্দর হয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম কোনো মার্কিন নাগরিক, যাকে মাদক পাচারের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হয়েছিল তার নতুন ঠিকানা। এই কারাগারে থাকতেই তরুণি বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন। শুধু তাই নয়, এদেশের সেই সময়ের জনপ্রিয় একটি বাংলা গান এলিয়েদার হৃদয় হরণ করে। ফলে সেই গান মুখস্ত করে ফেলেন মার্কিন এই তরুণী।
কারা সূত্র জানায়, সাড়ে চার বছর কারাগারে বন্দী থাকাকালীন বাংলা ভাষা শিখেছেন এলিয়েদা। তিনি বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতেন, নাচতেন ও গাইতেন। সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন মার্কিন এই সুন্দরী তরুণী। এ ছাড়া ধর্মীয় আলোচনাও করতেন খুব। বিশেষ করে তার খ্রিস্টান ধর্মের কথাই তিনি প্রত্যেককে বলতেন।
ভাষা শিকেহ ফেলায়, সে সময়ের আলোচিত বাংলা গানের সুর এলিয়েদার হৃদয় স্পর্শ করে, এরপরে ঘটে যায় মজার ঘটনা। সেটা পরে বলছি। গানের নাম, ‘কি ছিলে আমায়, বলো না তুমি…।’ এই গান মুখস্থ করে কারাগারে নিজের মতো করে গাইতেন। এক সময় ইচ্ছা প্রকাশ করেন গানের গায়কের সঙ্গে দেখা করবেন। তখন গানের গায়ক মনি কিশোর তুমুল জনপ্রিয়। তার দেখা পাওয়া কি চারটি খানি কথা? তাও আবার জেলে বসে।
তবে সুদূর মার্কিন মুলুকের এই তরুণির ইচ্ছের কথা চাপা রইলো না। চলে গেল, গানের গায়ক মনি কিশোরের কানে।, কিন্তু জনপ্রিয়তা মনি কিশোরকে সে অর্থে ছুঁয়েছে কি না, সেটা ভিন্ন কথা। মনি কিশোর ইচ্ছে পোষণ করলেন তিনি জেলে যাবেন। এবং সত্যিই তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গেলেন, এলিয়েদার স্বপ্ন পূরণ করলেন। মনি কিশোর গেলেন কারাগারে, দেখা করলেন এলিয়েদার সঙ্গে। শোনালেন সেই গান।
এইসব স্মৃতি এলিয়েদার হৃদয়ে গভীরভাবের দাগ কেটে গিয়েছিল। তিনি জেলে বসেই অনুশোচনায় ভুগেছিলেন। ফলে তাকে তার সাজা ম ওকুফ করা হয়েছিল। বাংলাদেশে এসে জীবনের এক চরম অধ্যায় পার করে গেলেও এই দেশকে ভুলতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন এলিয়েদা।
যাওয়ার সময় ঢাকা বিমানবন্দরে তিনি বলেছেন, ‘এ দেশের মানুষকে আমি কখনো ভুলব না। বাংলাদেশ সরকার আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে নতুন জীবন দিয়েছে, আমি এর মর্যাদা দেব। পরিবর্তন হয়ে এই দেশে একদিনের জন্যে হলেও আসব।’ হিথ্রো বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের জেলে থাকলেও আমাকে প্রথম শ্রেণির বন্দীর মর্যাদা দেওয়া হয়।’
মনি কিশোরের মতো মানুষদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন বলেই তিনি বদলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে সত্যিই বদলে গিয়েছিলেন এই মার্কিন তরুণী। দেশে ফিরেই লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি এসোসিয়েট ডিগ্রি এবং ২০০১ সালে ব্যাচেলর ডিগ্রি নেন। তিনি নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে চাকরি নেন। পরে এইএস করপোরেশনেও চাকরি করেন। ২০০৯ সালের ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে জনপ্রিয় ‘লকড আপ এব্রোড’-এর একটি পর্ব হয় এলিয়েদাকে নিয়ে। এলিয়েদা সেই চ্যানেলে সাক্ষাত্কারে বলেছেন সেসব ঘটনার আদ্যোপান্ত।
যেভাবে এলিয়েদা মাদক পাচারকারী
১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই এক মাসের শিক্ষা ভিসা নিয়ে ঢাকায় আসে এলিয়েদা। তাকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে নিয়ে যান মাদক সরবরাহকারী নাইজেরিয়ার নাগরিক রবার্ট ব্লাংকসন টনি। টনি পরে তার সঙ্গে দেখা করবে বলে হোটেলে রেখে চলে যায়। এদিকে এলিয়েদার দিন কাটতে থাকে হোটেলের রুমে শুয়ে বসে। একে একে দিন যেতে থাকে, কিন্তু তার সঙ্গে কেউ আর দেখা করতে আসে না। এভাবেই প্রায় দুসপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পর অস্থির হয়ে পড়ে লিয়া। দেশের কথা তার মনে পড়ে। মনে পড়ে বাবা-মায়ের কথা। মনের ভেতর তখন থেকে তার অজানা আশঙ্কা।
২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে এলিয়েদার সিদ্ধান্ত নেন, তিনি কাউকে কিছু না বলেই হোটেল থেকে বেরিয়ে দেশে ফিরে যাবেন। পরদিন দুপুরে ব্যাগ গুছিয়ে নেন। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে পড়েন। হোটেলের লবিতে যাওয়া মাত্র একজন বেল বয় তাকে সাহায্য করতে ছুটে আসে। ব্যাগ তাকে দিয়েই সামনে চোখ রাখতেই দেখেন মাদকের ডিলার টনিকে। টনি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করেন, কোথায় যাচ্ছ? এলিয়েদার জবাব, আমি আর দেরি করতে পারছি না। নইলে আমি ফ্লাইট মিস করব। টনি এ সময় উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তার হাত ধরে হোটেলের বাইরে নিয়ে যায়। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়িতে জোর করে তুলে নেয়। টনি তাকে ভয় দেখিয়ে বলে, টেক্সাসে তার ছোট ভাইয়ের ক্ষতি হয়ে যাবে তার কথামতো না চললে। এলিয়েদাকে নিয়ে যায় আরও একটি হোটেলে। সেখানেই টেপ দিয়ে এলিয়েদার শরীরের মধ্যে সাড়ে তিন কেজি হেরোইন পেঁচিয়ে দেয় টনি। সাড়ে তিন কেজি ওজনের হোরোইন শরীরে বেঁধে চলতে খুব সমস্যা হচ্ছিল এলিয়েদার। এলিয়েদা এ সময় টনির কাছ থেকে ডলার দাবি করে। কিন্তু টনি তাকে আশ্বাস দেয়। বলে টেক্সাসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডলার পেয়ে যাবে। এলিয়েদার বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লন্ডনের ফ্লাইটে উঠতে বোডিং পাস নিয়ে প্রস্তুত লিয়া। সে দেখতে পায় ওই ফ্লাইটের যাত্রীদের ব্যাগ এমনকি দেহ পর্যন্ত তল্লাশি চালানো হচ্ছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা, প্রত্যেক যাত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন, দেহ, ব্যাগ তল্লাশি করছেন। এ দৃশ্য দেখে ঘামতে থাকেন এলিয়েদার। প্রচণ্ড ভয় পান। এলিয়েদা ছিলেন লাইনের শেষ দিকে। এক পর্যায়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, টয়লেটে গিয়ে তার শরীরের বেঁধে রাখা জিনিসগুলো ফেলে দেবেন। সে অনুযায়ী টয়লেটে যান। চেহারায় পানির ঝাপটা দেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চেষ্টা করতে থাকে শরীরে বাঁধা জিনিসগুলো অপসারণ করতে। কিন্তু হচ্ছিল না। টয়লেটে আরও লোকজনের আনাগোনায় সে সেই কাজটি করতে পারেননি। তিনি জানেন, টয়লেট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই তার দেহ তল্লাশি করা হবে। ভয়ে ভয়ে টয়লেট থেকে বেরিয়ে আসেন। দেখতে পান কাস্টমস কর্মকর্তারা একজন যাত্রীর ব্যাগ দেহ তল্লাশি করছে। তার দিকে খেয়াল নেই কারও। এমন সুযোগ পাওয়া যেন তখন তার হাতে চাঁদ পেয়ে যাওয়া। এলিয়েদা সব বাধা অতিক্রম করে ফেললেন। এগিয়ে যাচ্ছেন রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির দিকে। সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। বাঁ-দিকে মোড় ঘুরতেই পেছন থেকে কেউ ডাকল, হ্যালো মিস! দাঁড়িয়ে গেলেন এলিয়েদা। উপর দিকে তাকাতেই দেখল তাকে ইশারা করে এক মহিলা কর্মকর্তা ডাকছেন। এলিয়েদা উপরে উঠে আসলেন। তার হাঁটা চলাতেই সন্দেহ আরও তীব্র হয় কর্মকর্তাদের। তাকে নেওয়া হলো একটি কক্ষে।
নারী কর্মকর্তারা তার দেহ তল্লাশি চালাল। হাত দিয়ে পেয়ে গেলেন তারা চারটি হোরোইনের প্যাকেট। যাতে ছিল প্রায় সাড়ে তিন কেজি ওজনের হেরোইন। পুলিশ তাকে জানায়, বাংলাদেশে হোরোইন পাচারের সর্বোচ্চ দণ্ড মৃত্যুদণ্ড। ভয় পায় ১৮ বছরের লিয়া। কাঁদতে থাকে। পুলিশ তাকে নির্ভয় দেয়। হোরোইন পাচারের মূল মালিকের নাম বলে দিলেই লিয়া বেঁচে যাবে বলে কথা দেয় পুলিশ কর্মকর্তারা। এলিয়েদা তখন বলে, সে রাজি। কিন্তু তাকে তো ভালো করে চেনেই না। পুরো ঘটনা খুলে বলেন এলিয়েদা। পরদিন যশোর বেনাপোল এলাকায় আটক হয় মাদকের ডিলার রবার্ট ব্লাংকসন টনি। সীমান্ত দিয়ে দেশ ত্যাগের চেষ্টা করছিল।